‘আমার স্বামী গুম হয়েছে, নয়টি বছর হয়ে গেল। রাষ্ট্র নির্বিকার, কোনো জবাব দিচ্ছে না। কোনো সহযোগিতা করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উচ্চ আদালতে আবেদন করেও কোনো সুরাহা হয়নি। এখন আমি কার কাছে যাব। পঁচাত্তরোর্ধ্ব আমার শাশুড়ি ইলিয়াসের শোকে কাতর হয়ে আজ প্রায় শয্যাশায়ী। আমার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। তারা বাবাহীন জীবনে অনেকটাই ছন্নছাড়া।’
কথাগুলো গতকাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন ‘গুম’ হওয়া সিলেট বিভাগীয় বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা। ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ হন। বিএনপি ও পরিবারের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের তুলে নিয়ে যায়। এরপর শুরুর দিকে দুই-তিন বছর সাবেক এই সংসদ সদস্যকে ‘গুমের’ অভিযোগে সারা দেশে হরতাল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিএনপি। একপর্যায়ে বিএনপিও ভুলে যায় ইলিয়াস আলীকে। শুধু দিবস এলেই তাকে নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সর্বশেষ গতকালও বিএনপি তার ‘নবম নিখোঁজ দিবস’ উপলক্ষে একটি ভার্চুয়াল আলোচনা সভা করে সিলেট বিভাগ জাতীয়তাবাদী সংহতি সম্মেলনী, ঢাকার ব্যানারে। সেখানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কাইয়ুম চৌধুরী।জানা যায়, বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলী রাজধানী থেকে নিখোঁজের পর ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে পরিবার। এখন পর্যন্ত আদালত কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে কোনো ধরনের আশ্বাসও পায়নি তারা। ইলিয়াস আলী বা আনসার আলী বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। পরিবার জানে না কোথায় আছেন তারা। ইলিয়াস আলীর পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় থাকেন। শুধু ইলিয়াসের মা থাকেন গ্রামের বাড়ি। অন্যদিকে আনসার আলীর স্ত্রী সিলেট সিটি করপোরেশনে একটি ছোট পদে চাকরি করে সন্তানদের নিয়ে স্বামীকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার দুই দিন পর তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল এ বিষয়ে হাই কোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। সেখানে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার স্বামীকে বেআইনিভাবে আটক করে রেখেছে। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীর মুক্তির জন্য তিনি হাই কোর্টে আবেদন করেন। ইলিয়াস আলীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করেছে- স্ত্রীর এই অভিযোগের পর, ইলিয়াস আলীকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, সরকারকে তা জানাতে বলে আদালত। স্বরাষ্ট্র সচিব থেকে শুরু করে বনানী থানার ওসি পর্যন্ত ১০ জনকে ১০ দিনের মধ্যে এই রুলের জবাবও দিতে বলা হয়। এরপর ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার এ বিষয়ে আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। হাই কোর্টও এ বিষয়ে কোনো পক্ষের শুনানি গ্রহণ করেনি। ফলে বিষয়টি এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পাঁচটি সংস্থার পক্ষ থেকে হাই কোর্টে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। সংস্থাগুলোর দাবি, ইলিয়াস আলীকে তারা তুলে নেয়নি বা আটক করেনি এবং ইলিয়াস আলী তাদের জিম্মায়ও নেই। এই পাঁচটি সংস্থার মধ্যে রয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের (আইজিপি) কার্যালয়, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও বনানী থানা। এ ছাড়া সংস্থাগুলো জানিয়েছে, তারা ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইলিয়াস আলীকে গুমের পেছনে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র তার সেই দায়িত্ব পালন করছে না। এতে বোঝা যায়, রাষ্ট্রই এর সঙ্গে জড়িত। আমরা সরকারকে বলব, আপনারা ইলিয়াস আলীকে অক্ষত অবস্থায় তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিন।’
তাহসিনা রুশদীর লুনার আইনজীবী ও বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো দাবি করেছে, তারা ইলিয়াস আলীকে আটক করেনি। তাই হাই কোর্টে ইলিয়াস আলীর শুনানির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। এ কারণেই এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান পাননি তার স্ত্রী। আমরা হাই কোর্টের রুলের বিষয়ে শুনানির উদ্যোগ নিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হবে, তারা ইলিয়াস আলীকে আটক করেনি। ইলিয়াস আলী ও আনসার আলীর পরিবার এখনো তাদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়।’
তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, ‘আমি এখনো আমার স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় আছি। আমি মনে করি, আমার স্বামী জীবিত আছেন। সরকারই কোথাও তাকে গুম করে রেখেছে। যে কোনো শর্তের বিনিময়ে অবিলম্বে আমার স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত চাই।’