পানির ওপর ভাসছে সব দোকান। নৌকায় নৌকায় এসব দোকান মিলে এক বাজার-ভাসমান বাজার। দৃশ্যটি থাইল্যান্ডের নয়, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে বসা ভাসমান বাজারের দৃশ্য। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নদীর বুকে নৌকায় বসে এ বাজার। দুপুরের আগেই ভেঙে যায় বাজার। সপ্তাহের দুই দিন শনি ও মঙ্গলবার বসে এই ভাসমান বাজার। নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বেলুয়া নদী। নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার ও বেলুয়া মুগারঝোর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেলুয়া নদী। নাজিরপুর, নেছারাবাদ ও বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সীমান্তে এ বেলুয়া নদী। প্রায় ৭০ বছর ধরে স্থানীয় ২০ থেকে ২৫ গ্রামের কৃষক খেতের সবজি, ধান ও চাল কেনাবেচা করছেন এ ভাসমান বাজারে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সূর্যোদয়ের পর বেলুয়া নদীর আশপাশ এলাকার খাল বেয়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কৃষকরা সবজি নিয়ে বাজারে আসেন। সকাল ৬টার মধ্যে সরগরম হয়ে ওঠে বাজার। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ট্রলার ও ছোটবড় নৌকা নিয়ে এ বাজারে এসে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে নিয়ে যায়। নদীর নাম বেলুয়া হলেও স্থানীয়রা এ নদীকে চেনেন বৈঠাকাটা নামে। বৈঠাকাটা নদীকে ঘিরে বসবাস করেন কয়েক হাজার কৃষিজীবী। তাদের উৎপাদিত নানারকম কৃষিপণ্য বেচাকেনার একমাত্র স্থান এ ভাসমান বাজার। বাজারে বিক্রি হয় মৌসুম ভেদে নানা রকম শাকসবজি। হাটের এক পাশে রয়েছে ধান, চাল, মুড়ি ও নারকেলের হাট। স্থানীয় কৃষিজীবীরা জানান, তাদের গ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবার নানা রকম সবজি চাষ করে। তাদের উৎপাদিত এসব সবজি ভাসমান বাজারে বিক্রি করেন। এ বাজারে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার কারণে আশপাশের গ্রামগুলোর কৃষকও এখানে পণ্য বিক্রি করতে আসেন। এখান থেকে কৃষিপণ্য কিনে পাইকাররা রাজধানীসহ আশপাশের জেলা, উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করে থাকেন।
স্থানীয় প্রবীণ কৃষিজীবীরা জানান, পঞ্চাশ দশকের শুরুতে মুগারঝোর গ্রামের সেকান্দার আলী সরদার, কেরামত আলী, দলিল উদ্দিন সরদার ও আবুল কাশেম তালুকদার নামে কয়েকজন বৈঠাকাটা ভাসমান বাজার শুরু করেন। দিনে দিনে বাজারের ব্যাপ্তি বেড়েছে। নাজিরপুর উপজেলার কলারদোয়ানিয়া, মুগারঝোর, মনোহরপুর, গাঁওখালী, চাঁদকাঠি, ডুমুরিয়া, সাচিয়া, লড়া, বইবুনিয়া, পেনাখালী, নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া, গগন, মলুহার, কাটাখালী, উলুহার, জনতা, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি, উমারের পাড়, উদয়কাঠি, কদমবাড়ী, বাইশাড়ি, চৌমোহনাসহ আশপাশের গ্রামের কৃষক তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য এ বাজারে বিক্রি করে থাকেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে কৃষিপণ্য কিনে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে নিয়ে যান। এ হাটের কৃষিপণ্য ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি হয়। বৈঠাকাটা বাজার কমিটির নেতারা জানান, এক সময় এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল নৌকা। প্রতিটি কৃষক পরিবারে নৌকা আছে। বাজার প্রতিষ্ঠার পর আশপাশের গ্রামের কৃষক নৌকায় করে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য হাটে নিয়ে আসতেন। ক্রেতারা কৃষিপণ্য কেনার জন্য নৌকায় করে হাটে আসতেন। বৈঠাকাটা বাজার সংলগ্ন বেলুয়া নদীতে নৌকায় বসে চলত কেনাবেচা। এভাবে নৌকা থেকে নৌকায় পণ্য বেচাকেনা করতে করতে ভাসমান বাজার শুরু। এখনো এসব গ্রামের মানুষের অন্যতম বাহন নৌকা। নাজিরপুর উপজেলার কলারদোনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাসনাত ডালিম জানান, এ অঞ্চলের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষক। স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বৈঠাকাটা ভাসমান বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয়। সারা বছর ধরে ভাসমান বাজারে কেনাবেচা হলেও শীত মৌসুমে বাজারটি জমজমাট বেশি থাকে।