মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

পাচার হওয়া কিশোরীকে ফিরিয়ে আনতে মা-বাবার করুণ মিনতি

আলাউদ্দিন আরিফ

ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাচার হওয়া কিশোরীকে ফিরিয়ে আনতে করুণ মিনতি জানিয়েছেন তার মা-বাবা। মাত্র নবম শ্রেণিতে ওঠা সাথী (ছদ্মনাম) নামে ওই কিশোরী পড়ত রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বিজি প্রেস উচ্চবিদ্যালয়ে। সিএনজি অটোরিকশাচালক বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। নার্সিং পেশায় গিয়ে মানুষের সেবা করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে টিকটক অ্যাপস। বাবা আনোয়ার (ছদ্মনাম) চোখের পানি ছেড়ে বলেন, ‘আমার সব শেষ। এখন আশায় আছি যদি মেয়েটাকে ফিরে পাই। পুলিশের কাছে গিয়েছি। থানায় মামলা করেছি। এখনো আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি।’

পাচার হওয়া কিশোরী সাথীর বয়স ১৫ বছর। বৃহস্পতিবার ৮ জুলাই তার বাবা রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশায় মামলা করেছেন। মামলার আসামিরা হলেন রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু, সুবজ, সাগর ও রুবেল ওরফে রাহুল। বাদী বলেন, ‘ভাড়ায় সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে এক কক্ষের ভাড়া বাসায় থাকি। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। এ সময় মেয়ে মাঝে মধ্যে মা ও ছোট বোনসহ বাসার পাশেই হাতিরঝিলে ঘুরতে যেত। সেখানে আরও কয়েকজন ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। হাতিরঝিলে টিকটক ভিডিও বানাত হৃদয় বাবুসহ আরও কয়েকজন। আমি বিষয়টি জানতে পেরে মেয়েকে হৃদয়সহ ওই সব ছেলে-মেয়ের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করি। সে আমাকে কথা দেয়, কখনো মিশবে না। কিন্তু ১৭ মার্চ হাতিরঝিলে ঘুরে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সাথী। এর পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাইনি। ২ জুন টেলিভিশনে আমাদের এলাকার একটি মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখি। ওই মেয়েকে ছবি দেখালে সে আমার মেয়ে সাথীকে শনাক্ত করে। তার কাছ থেকে জানতে পারি, আমার মেয়ে সাথীকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। ওই মেয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশি মেয়েদের ভারতের হায়দরাবাদ, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুতে পাচার করে নির্যাতন ও পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করেছে টিকটক হৃদয়সহ কয়েকজন। এই পাচারে জড়িত টিকটক হৃদয়, সবুজ, সাগর ও রুবেল ওরফে রাহুলসহ আরও কয়েকজন আমার মেয়েকে পাচার করেছে।’ আনোয়ার বলেন, ‘আমার মেয়েকে ভারতের একটি বিউটি পারলারে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে। আমি বহু দিন তার কোনো খোঁজ পাইনি। একবার যদি আমার মেয়েটাকে ফিরে পেতাম বা তাকে দেখতে পারতাম! পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, সে বর্তমানে কলতাকার একটি সেফ হোমে আছে।’

সাথীর মা কোহিনূর (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার মেয়ে এভাবে চলে যাবে একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে তাকে যেতে দিতাম না। সাথী হাতিরঝিল এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেত। তাকে কলকাতার বিউটি পারলারে ভালো বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে। আমার মেয়ের কাছে ইসরাত নামে এক মেয়ে আসত। সে বলত, তার বাড়ি জিঞ্জিরায়। সেই ইশরাতই আমার মেয়েকে পাচার করে টিকটক হৃদয় বাবুর হাতে তুলে দিয়েছে। আমার মেয়ে ছাড়াও ইশরাতকে একই এলাকার রেখা নামে আরও এক মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে দেখা যায়। কিন্তু রেখাকে এখন আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।’ চোখের পানি ছেড়ে সাথীর মা বলেন, ‘আমার মেয়ে এই বছর অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উঠেছে। তার নতুন কেনা বইগুলো ঘরে পড়ে আছে। সারা দিন শুধু ভাবী, কখন মেয়ে ঘরে আসবে, নতুন কেনা বইগুলো পড়বে। আমরা থানায় গিয়েছি, মামলা করেছি। পুলিশ বলছে, চেষ্টা করছি। কিন্তু মেয়েকে কখন ফিরে পাব তা জানি না। পুলিশও পরিষ্কার কিছু বলতে পারছে না।’ শুধু সাথী নয়, বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক কিশোরী ও নারী প্রযুক্তির অব্যবহারের শিকার হয়ে প্রতি বছর পাচারের শিকার হন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের বরাত দিয়ে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা জানিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ বছরে ৫০০ নারী ও আট বছরে এক হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।  সাথীকে উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদারকি কর্মকর্তা তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘পাচার হওয়া তরুণীকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এ ছাড়া পাচারকারী আসামি টিকটক হৃদয়সহ অন্যদের ফিরিয়ে এনে তাদের শাস্তি কার্যকরের বিষয়ে আমরা পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখার (ইন্টারপোল) মাধ্যমে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমরা জেনেছি, বেঙ্গালুরু পুলিশ হৃদয়সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে এ সপ্তাহেই আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে।’ পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘টিকটক, লাইকি ও ফেসবুকসহ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যে এভাবে নারী পাচার কার্যক্রম চলছে, তা বুঝতে আমাদের কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। আমরা মনে করেছিলাম এই অ্যাপসগুলো শুধু আনন্দ দেওয়ার জন্য এবং সেগুলো দুনিয়াব্যাপী চলছে। কিন্তু পরে দেখলাম, তরুণদের একটা গ্রুপ এসব অ্যাপসের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে অপরাধ করছে। আমরা এগুলো নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি।’

সর্বশেষ খবর