শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

কাজ খুঁজছে মানুষ বদলাচ্ছে পেশা

কর্মহীন ১৪ লাখ । শিক্ষক পরিবহন শ্রমিক বেসরকারি কর্মকর্তা শ্রমজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ঝুঁকছেন অন্য পেশায় । কেউ বিক্রি করছেন সবজি, কেউ কৃষিকাজে

জিন্নাতুন নূর

কাজ খুঁজছে মানুষ বদলাচ্ছে পেশা

পুরান ঢাকার একটি কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ আজহার হোসেন। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার করে নিজের মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনের কাজ শুরু করেন। সংসার চালাতে গিয়ে আয়ের কোনো পথ না পেয়ে এই কাজ শুরু করেন আজহার।  আজহারের মতো দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটছে দেশের অন্তত সাড়ে ৭ হাজার নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক শিক্ষকের। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এসব স্কুলের অনেকগুলোই হয়তো আর কখনো খুলবে না। ফলে এর সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীও পেশায় আর ফিরবেন না। এরই মধ্যে অর্থ সংকটে পড়ে অনেক অধ্যক্ষ স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ করে আসবাবপত্র বিক্রি করে দিয়েছেন। বিশেষ করে যেসব কিন্ডারগার্টেন মহামারী শুরুর আগে ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছিল তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি না পেয়ে এমনটি করছেন। এই শিক্ষকদের কেউ এখন সবজি আবার কেউ মৌসুমি ফল বিক্রি করেন। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর বিধিনিষেধে ব্যবসা-বাণিজ্য ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর থেকে শুরু করে শিক্ষক, পরিবহন শ্রমিক, বেসরকারি কর্মকর্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। আগের কাজ হারিয়ে তারা নতুন করে কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছেন। কেউবা অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। তবে করোনায় বেশি ক্ষতি হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। অসংখ্য ছোট ব্যবসায়ী হারিয়েছেন পুঁজি। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেসরকারি লাখ লাখ মানুষও চাকরি হারিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি হিসাব বলছে, করোনা সংক্রমণের ফলে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখে। করোনাকালে  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকায় এবং সরকার থেকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় অনেক শিক্ষক ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষিকাজ ও দিনমজুরের কাজ করছেন। বিভিন্ন কেজি স্কুলের শিক্ষকরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গত বছরের মার্চে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার পর কয়েক মাস পর্যন্ত তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু পরে ছুটি বাড়তে থাকে এবং খুলে দেওয়ার সম্ভাবনাও কমতে থাকে। এরপর থেকে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকরা খুবই কম বেতন পান। টিউশনি করেই বেশির ভাগ শিক্ষক তাদের ব্যয়ের চাহিদা পূরণ করেন। কিন্তু সেই টিউশনিও এখন বন্ধ। মিরপুরের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি করতেন হুমায়ুন আহমেদ। করোনায় ২০২০ সালের মার্চে স্কুল বন্ধ হয়ে পড়লে সংসার চালাতে মৌসুমি পণ্য বিক্রি শুরু করেন। কখনো আম আবার কখনো সবজি বিক্রি শুরু করেন এই শিক্ষক। স্কুল চালু থাকা অবস্থায় স্কুলের পাশাপাশি তিনি কিছু শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন। কিন্তু সেটিও এখন বন্ধ। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের করা ‘পোভার্টি ইমপ্যাক্ট অব কভিড-১৯’ শীর্ষক এক জরিপ থেকে জানা যায়, করোনার কারণে শহরাঞ্চলে ৮০ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। গ্রামে এ সংখ্যা ৭৯ শতাংশ। আর নতুন সৃষ্ট দরিদ্র শ্রেণির ৭১ শতাংশ আয় কমে গেছে। এতে জানানো হয় সংকট শুরু হওয়ার পর ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও ধারদেনা করে মানুষজন চলছে। এতে উল্লেখ করা হয়, মহামারীতে নিম্নআয়ের মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারীতে মানুষের আয়ই শুধু কমেনি, চাকরিও হারিয়েছেন অনেকে। এদের বড় একটি অংশ পেশা বদলে টিকে থাকার লড়াই করছে। সঞ্চয় যা ছিল তাও ফুরিয়ে এসেছে অনেকের। ঘরের আসবাবপত্র ও মূল্যবান সম্পদও বিক্রি করে নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেস্টুরেন্ট ও খাবার হোটেল ব্যবসায়ীদের অনেকেই আসবাবপত্র বিক্রি করে দিচ্ছেন। মহামারীতে ক্রেতা না থাকায় হোটেল কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল দিতে হিমশিম খেয়ে হোটেল ব্যবসায়ীরা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। করোনায় পেশা বদলাচ্ছেন স্বর্ণকাররাও। কাজ না থাকায় কেউ কেউ বাড়ি ফিরে গিয়ে কৃষিকাজ করছেন। কেউবা সবজি বিক্রি করছেন। একটি ছোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিয়ন হিসেবে কাজ করতেন জুয়েল সাহা। কিন্তু করোনায় সেই প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না দেখে খাবার ডেলিভারি কাজ করছেন। জুয়েল বলেন, ‘বাসায় বয়স্ক মা-বাবা ও ছোট ভাই আছে। কাজ না করলে তাদের উপোস থাকতে হবে।’ ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের কম্পিউটারের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন ইয়াছিন আলী। লকডাউনে দীর্ঘদিন দোকান বন্ধ। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় বেতনও পাননি কয়েক মাস। শেষে রাস্তায় মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি শুরু করেন জুয়েল। এ ছাড়াও রাজধানীর ছোট ইলেকট্রনিক্স পণ্য মেরামতের দোকান, ডেকোরেটরের দোকান, রকমারি খাদ্যপণ্যের দোকান এবং পোশাকের দোকানগুলোর বন্ধ শাটারের ওপর এখন দোকান ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞাপন ঝুলছে। লোকসানে পড়ে এসব দোকানি ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। আবার করোনায় শিক্ষিত নিম্ন-মধ্যবিত্তদের কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে রিকশা ও ভ্যান চালাচ্ছেন। কর্মহীনদের কেউ কেউ রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ চা ও পান-সিগারেট বিক্রি করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনায় পেশাজীবীদের ওপর বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে। শুরুতে এই প্রভাব নিম্নআয়ের লোকজনের ওপর পড়ে। এক সময় তা উচ্চশ্রেণির মানুষের ওপর গিয়ে পড়বে। তিনি বলেন, গৃহকর্মী, দিনমজুর, ব্যাংক কর্মী, উচ্চ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সবাই কোনো না কোনোভাবে করোনাকালে অর্থনৈতিক ধাক্কা খাচ্ছেন। এতে অনেকেই বাঁচার তাগিদে নিজেদের পেশাগত পরিচয় পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি কোন রূপ নেবে তা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না।’

সর্বশেষ খবর