মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

পাত্রীপক্ষ দিল খুনির খোঁজ

মির্জা মেহেদী তমাল

পাত্রীপক্ষ দিল খুনির খোঁজ

গাজীপুরের জয়দেবপুরের একটি ডোবা থেকে পুলিশ ৬৫ বছরের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। ফুলে পচে যাওয়া লাশটির পরিচয় মেলে কয়েকদিন পর। তার নাম সাহেব আলী। বাড়ি কুড়িগ্রাম হলেও থাকতেন গাজীপুরে। সেখানেই কবিরাজি করতেন। ছেলে লাবলু হাসান বাবার লাশ শনাক্ত করেন। লাবলু হাসান জয়দেবপুর থানায় মামলা করেন। পুলিশ মামলার তদন্ত শুরু করে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি। লাবলু হাসান পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি থাকেন কুড়িগ্রামে। তার বাবা গাজীপুরে জনৈক সালাম সাহেবের বাসায় সাবলেট থাকতেন। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।

পুলিশ খুঁজে বের করে সালাম সাহেবের বাসা। কিন্তু সে বাসায় তারা নেই। বাড়িওয়ালা পুলিশকে জানান, সালাম সাহেব তাদের ভাড়াটিয়া। সালামের মেয়ে মর্জিনার স্বামী সাহেব আলীও থাকতেন একসঙ্গে। হঠাৎ সাহেব আলী নিখোঁজ হন। এর পরই সালাম তার পরিবার-পরিজন নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে যান। সালাম তাকে জানিয়েছিলেন একদিন রাতে বাসা থেকে সাহেব আলী বেরিয়ে যান। কিন্তু কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও আর ফেরেননি। এ কারণেই তারা ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা গেছেন ময়মনসিংহ।

সালামদের বাসায় গিয়ে পুলিশ একটি নতুন তথ্য পায়। সাহেব আলী সাবলেট থাকতেন না। থাকতেন শ্বশুড়বাড়িতে। এ কথা সাহেব আলীর ছেলে লাবলু হাসানও জানতেন না। লাবলু হাসান তার বাবার সম্পর্কে পুলিশকে জানিয়েছেন তার বাবা কুড়িগ্রামে দুটি বিয়ে করেছেন। তারা জানতেন গাজীপুরে তিনি একটি বাসায় সাবলেট থাকতেন। বিয়ে করেছেন তা জানতেন না লাবলু হাসান। পুলিশ এসব শুনে সন্দেহ করে সাহেব আলীর শ্বশুর সালাম পরিবারের ওপর। পুলিশ এবার সালাম ও তার পরিবারের সদস্যদের খোঁজে মাঠে নামে। এর আগে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডিকে।

সিআইডি টিম ঘাতকদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার পাথারীগাঁও ঘিরে তদন্ত শুরু করে। তারা ওই গ্রামে লুঙ্গি পরে ছদ্মবেশে অবস্থান করে। এক বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাত্রী দেখতে যায় সিআইডি টিমটি। পাত্রী দেখার ফাঁকে টিমের এক সদস্য ওই বাড়ির লোকদের বলেন, এ গ্রামের সালাম নামের এক লোকের সঙ্গে আমি অনেকদিন আগে চাকরি করেছি। তার কাছ থেকেই এ গ্রামের নাম শুনেছি। কিন্তু তার বাড়ি চিনি না। মোবাইল নম্বরও নেই। আপনারা কি তাকে চেনেন?

তখন পাত্রীপক্ষের লোকজন জানান, সালামের বাড়ি তাদের বাড়ির পাশেই। এ পর্যায়ে জানতে চাওয়া হয় ওরা কেমন লোক। ওই সময় তারা জানান, ওরা খুব একটা ভালো লোক না। শুনেছি কিছুদিন আগে গাজীপুরে খুন করে পালিয়ে আসে। এক-দেড় মাস থাকার পর তারা আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

পরে সালাম ও তার পরিবারের সদস্যদের খোঁজে ভালুকা সিডস্টোর এলাকায় ছুটে যায় সিআইডি টিম। প্রথমে সালামের ছেলে সবুজের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন সিআইডি কর্মকর্তা। সবুজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আটক করা হয় সবুজকে। পরে মর্জিনা, মা রিনা ও বোন অনোয়ারাকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাবনবন্দিও দেন।

কুড়িগ্রামে দুই স্ত্রী ও সন্তানদের না জানিয়েই ২০১৩ সালে সাহেব আলী বিয়ে করেন মর্জিনাকে। মর্জিনার পরিবার জানত সাহেব আলীর এক স্ত্রী আছেন তবে তাকে তালাক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরে জানতে পারে সাহেব আলীর দুই বিয়ের কথা। এ নিয়ে সাহেব আলীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তারা। সাহেব আলীর সন্তানরা সবাই আবদুস সালামকে চাচা বলতেন এবং জানতেন তাদের বাবা এ বাড়িতে সাবলেট থাকছেন।

মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে সাহেব আলীর আরেক ছেলে বাবলু হাসানের সঙ্গে মর্জিনার ছোট বোন রিনা বেগমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং পরে তারা বিয়ে করেন গোপনে। এ খবর সাহেব আলী না জানলেও মর্জিনারা জানতেন। রিনা-বাবলুর সম্পর্কের কারণে সাহেব আলী ও মর্জিনার মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়।

তার জেরেই খুনের পরিকল্পনা আঁটেন তারা। মা আনেয়ারা ও ছোট বোন রিনাকে নিয়ে গার্মেন্ট কর্মী মর্জিনা (৩০) বালিশচাপা দিয়ে খুন করেন ৬৫ বছরের সাহেব আলীকে। খুন করে রাত ২টার দিকে লাশ বাড়ির ৩০০ গজ দূরে পতিত জমিতে ফেলে আসেন। পরে সেখান থেকে ফেলে দেওয়া হয় একটি ডোবায়। খুনের রাতে শ্যালক শরীফ ও শ্বশুর আবদুস সালাম গ্রামের বাড়ি ছিলেন। পরদিন মর্জিনারা বিষয়টি তাদের জানান। পরে সবাই মিলে বাড়িওয়ালাকে বলে বাসা ছেড়ে দেন। তারা প্রথমে ময়মনসিংহ ও পরে ভালুকার সিডস্টোর এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। সিআইডি তাদের সেখান থেকেই গ্রেফতার করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর