শুক্রবার, ৫ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকা-কুমিল্লা বৈদ্যুতিক রেললাইন

কর্ডলাইন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ঢাকা-কুমিল্লা বৈদ্যুতিক রেললাইন

বর্তমানে দেশে যে রেলপথ আছে এর বেশির ভাগই মিটারগেজ। ফলে এসব লাইনে রেলের সর্বোচ্চ গতি ওঠে ৬০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। ব্রিটিশ আমলের এই রেলপথে কিছু সংস্কার হলেও এর খোলনলচে বদলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তটি হচ্ছে- দেশের সবগুলো রেলপথ বৈদ্যুতিক লাইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। গতি বাড়াতে ডিজেলের পরিবর্তে রেল চলবে বিদ্যুতে। সূত্র জানায়, চীন-জাপানের রেলপথে যেখানে ইলেকট্রিক ট্রেনের গতির প্রতিযোগিতা চলছে, সেখানে বাংলাদেশ পড়ে আছে মান্ধাতার আমলে। এ ছাড়া ডিজেলচালিত রেলে সরকারের অপচয় বাড়ছে। অনিয়ম দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ জ্বালানির অপচয় হয় রেল বিভাগে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে বছর বছর। এ অবস্থায় সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে অনুষ্ঠিত এক সভায় ডিজেলের পরিবর্তে বৈদ্যুতিক রেলপথ করার বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তটি রেল মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে অর্থ বিভাগ। শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে প্রস্তাবিত ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পটির দ্রুত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের। প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

ইআরডির এডিবি-৩ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করতে চায় এডিবি। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে রেল বিভাগকে বলা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা (সাসেক) রেলপথ কানেকটিভিটির আওতায় ঢাকা কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে এডিবি। গত ১০ অক্টোবর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) এই প্রকল্পের উপযোগিতা তুলে ধরেন এডিবির ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (দক্ষিণ এশিয়া) মনমোহন প্রকাশ।

সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এডিবির ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল মনমোহন প্রকাশ আঞ্চলিক যোগাযোগের আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তারা চীনে উচ্চগতির রেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন, যার ফলে রাজধানী বেইজিংয়ের সঙ্গে জিয়ানে যোগাযোগের সময়সীমা ১৫ ঘণ্টা থেকে সাড়ে চার ঘণ্টায় নেমে এসেছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মাথাপিছু জিডিপি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তিনি জাপানে একই ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদাহরণ দিয়ে বলেন, টোকিও-উসাকা হচ্ছে উচ্চগতির রেলপথের আরেকটি সফল প্রকল্প। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশেরও দ্রুতগতির  রেললাইনে যুক্ত হওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি।  সূত্র জানায়, সংস্থাটির পক্ষ থেকে তিনটি রেলরুটের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। (১) ঢাকা-আখাউড়া-চট্টগ্রাম (ডুয়েলগেজ) (২) ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম (ব্রডগেজ) এবং (৩) ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম (হাইস্পিড)।

এডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে মোট ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার রেলপথ আছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৮৪৬ কিলোমিটার মিটারগেজ এবং ৬৭৭ কিলোমিটার হচ্ছে ব্রডগেজ। এ ছাড়া ডুয়েলগেজ রেলপথের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪১২ কিলোমিটার। দেশের মূল করিডরে যুক্ত দুটি প্রধান রেললাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম (৩২০ কিলোমিটার) এবং ঢাকা-সিলেট (৩০০ কিলোমিটার) দুটিই মিটারগেজ। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে মনমোহন প্রকাশ বলেন, আলোচ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামের যাতায়াত সময়সীমা অন্তত ২ ঘণ্টা কমানো যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরে দ্রুতগতির রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সূত্র জানায়, সভায় রেল বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরে ডুয়েলগেজ রেললাইনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে লাকসাম পর্যন্ত এরই মধ্যে ডুয়েলগেজ করা হয়েছে বলেও জানান রেলের প্রতিনিধি। রেল বিভাগের যুক্তি খন্ডন করে ডুয়েলগেজ রেললাইনের ঝুঁকিগুলো তুলে ধরে এডিবি। সভায় সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ডুয়েলগেজ রেলের গতি কমায়। জটিল সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার কারণে এটি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের কোথাও ডুয়েলগেজ রেললাইনের সাফল্য নেই বলেও এডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়। এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি জানান, ব্রডগেজ ডাবললাইন দুর্ঘটনামুক্ত। এ ছাড়া ব্রডগেজ লাইনে প্রতি ঘণ্টায় যেখানে ১২ হাজার টন মাল পরিবহন করা যায়, সেখানে মিটার গেজে মাত্র ২ হাজার টন মাল পরিবহন সম্ভব। এ সময় ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রজেক্টে এলিভেটেড রুটের বিষয়ে আগ্রহ দেখায় রেল বিভাগ। আলোচ্য প্রকল্পে এলিভেটেড রুট নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরা হয় রেল বিভাগের পক্ষ থেকে। তবে এলিভেটেড রেলপথ নির্মাণে অপ্রয়োজনীয় লেভেলক্রসিং তৈরি হবে বলে জানায় এডিবি। এ পর্যায়ে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, রেলের গতি বাড়াতে সরকার ডিজেল রুটগুলো বৈদ্যুতায়নের (ইলেকট্রিফিকেশন) পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ কারণে আমাদের ডুয়েলগেজ রেললাইন পরিহার করতে হবে, কারণ এটি গতি কমায়। তিনি ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পটির দ্রত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই রুটটি ডিজেল থেকে বৈদ্যুতিক রেল চালানোর উপযোগী করার অনুরোধ জানান রেল বিভাগকে।

সর্বশেষ খবর