শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
হোসনি দালান

শিয়াদের চেতনা-অস্তিত্বের বাতিঘর

মোস্তফা মতিহার

শিয়াদের চেতনা-অস্তিত্বের বাতিঘর

হোসনি দালান নিছক ইমামবাড়া নয়, এটি শিয়াদের চেতনা ও অস্তিত্বের ধারক। সেই সঙ্গে ইতিহাসের গর্বিত অংশীদারও। কালের পরিক্রমায় হোসনি দালান ইমামবাড়াটি শুধু শিয়াদের ইতিহাসই নয়, রাজধানী ঢাকার ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার তেজপাতা গলিতে। মহানগরীর চকবাজার থানার অন্তর্গত ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চানখাঁর পুলের তেজপাতা গলিতে অবস্থিত হোসনি দালান শুধু ইমাম হোসেন (রা.) এর স্মরণে নির্মিত স্থাপনাই নয়, এটি বাংলাদেশি শিয়া ভক্তদের বিশ্বাস ও চেতনাও। ইমারতের গায়ে শিলালিপিতে ফারসি ভাষায় লিখিত কবিতা অনুসারে এর প্রকৃত উচ্চারণ হোসায়নি দালান। ৬১ হিজরির ১০ মহররম অর্থাৎ ৬৮০ সালের ১০ অক্টোবর ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ইসলামের শত্রু ইয়াজিদ কর্তৃক নির্মমভাবে শহীদ হন প্রিয় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর নাতি ইমাম হোসেন (রা.)। আর তাঁরই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও ইমাম হোসেনের স্মরণে স্মৃতিসৌধ হিসেবে নির্মাণ করা হয় হোসনি দালান। এটি সাদা রঙের এবং এর বহিরাংশে নীল রঙের ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারুকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। পূর্বদিকের একটি সিঁড়ির সাহায্যে এই মঞ্চে উঠতে হয়। পাশাপাশি সংযুক্ত দুটি হলরুম নিয়েই মূল ইমারত। এর মধ্যে দক্ষিণমুখী ‘শিরনি’ হলটি ইমাম হোসেনের মৃত্যুর জন্য দুঃখ ও শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে কালো রং করা হয়েছিল। উত্তরমুখী ‘খুতবা’ হলে রয়েছে সাত ধাপবিশিষ্ট একটি কাঠের তৈরি মিম্বার। শেষের হলরুমটিতে ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতীক ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুটি হলের ডানে ও বামে নারীদের জন্য দ্বিতলবিশিষ্ট সম্পূরক হলরুম নির্মিত হয়েছে। দক্ষিণ দিকের সম্মুখভাগের দুই প্রান্তে দুটি তিনতলা বহুভুজ ফাঁপা বুরুজ রয়েছে। বুরুজগুলোর শীর্ষে রয়েছে গম্বুজ। ইমারতের দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃতির পুকুর ও উত্তরাংশে শিয়া বংশো™ভূত ব্যক্তিদের কবরস্থান। বর্তমানে তিনজন খাদেম ও একজন সুপারিনটেন্ড্যান্ট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এই ইমামবাড়াটি। শিয়া সম্প্রদায়ের এই ইমামবাড়াটির প্রধান প্রবেশপথে রয়েছে দারুল কোরআন নামের একটি লাইব্রেরি। আর মূল ফটক শেষে পশ্চিম দিকে রয়েছে দারুল শেফা নামের একটি হাসপাতাল। শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের সমাজসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই হাসপাতালটি। ১৭০০ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত হয় (প্রায় পৌনে ৪০০ বছরের পুরনো) শিয়া সম্প্রদায়ের এই স্থাপনাটি। তবে ইমারতটির নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। ইমামবাড়াটির দেয়ালের শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তার নৌ-সেনাপতি সৈয়দ মীর মুরাদ ১৬৪২ সালে হোসনি দালান ইমামবাড়াটি নির্মাণ করেন। প্রথমে তিনি একটি তাজিয়া কোনা নির্মাণ করেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইয়ে ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটিতে হোসনি দালানের নির্মাতা সৈয়দ মীর মুরাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহাসিক এম হাসান দানীর মতেও, মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। সৈয়দ মীর মুরাদ একদা স্বপ্নে ইমাম হোসেনকে একটি ‘তাজিয়াখানা’ নির্মাণ করতে দেখে এই ইমারত নির্মাণে উৎসাহিত হন। তিনিই এই ইমারতের নাম রাখেন হোসনি দালান। ইমামবাড়াটি নিয়ে এমন লোককাহিনিও প্রচলিত রয়েছে। প্রথমে এটি ছোট্ট একটি তাজিয়া বা স্থাপনা ছিল। পরে এটি ভেঙে গেলে নায়েব-নাজিমরা নতুন করে তা পুনরায় নির্মাণ করেন। ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকেছিল এমনটি নিজের বইয়ে উল্লেখ করেন ইতিহাসবিদ জেমস টেলর। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেন। ১৯৯৫-এ একবার এবং পরবর্তীতে ২০১১-তে আবার দক্ষিণের পুকুরটির সংস্কার করা হয়। ইরান সরকারের উদ্যোগে এবং তাদের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ওই বছরই হোসনি দালানের ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়। ইরানের স্থপত্যবিদ ও শিল্পীরা দেশটির ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কার কাজে তুলে ধরেন। সংস্কারের আগে ভিতরে রংবেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় ইরান থেকে আমদানি করা টাইলসে সেই দেশের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ইমারতটির প্যারাপেটে রয়েছে রঙিন পদ্ম-পাঁপড়ির নকশা। এর চার কোণের শীর্ষে রয়েছে চারটি ছত্রী। এখানকার একজন খাদেম জানান, মহররমের ১০ দিন পর থেকে দুই মাস ৮ দিন পর এখানে গাম-এ-হোসাইন বা হোসাইনের শোক পালন করা হয়। এই শোক পালন উপলক্ষে ইমারতের জারি-এ-মোবারক থেকে আলাম বা পাঞ্জা বের করা হয়। মহররমের ৪০ দিন পর জুলুস বা মিছিল বের করা হয় বলেও জানান এই খাদেম। ইসলামের দুশমন ইয়াজিদ কর্তৃক ইমাম হোসেনকে নির্মমভাবে শহীদ করার কারণে প্রতি বছরের ৯ রবিউল আউয়াল শোক, বিক্ষোভ, মাতমসহ নানা আয়োজনে ইয়াজিদের ওপর নালত বা অভিশাপ পাঠায় শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় শিয়া ভক্তদের হৃদয়ে আজও ইমাম হোসেন (রা.) চিরজাগরূক হয়ে আছেন এ বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে সরেজমিন হোসনি দালান পরিদর্শনে। দিনরাত সারাক্ষণই ভক্তরা ভিড় জমান ইমামবাড়ায়। জারি-এ-মোবারক জিয়ারত করা, আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো, উপহারসামগ্রী প্রদান করার পাশাপাশি হলরুমে নামাজও পড়েন ভক্তরা। আর মনের বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে ইমামবাড়ার নিচে এক কোনার নির্ধারিত স্থানে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনাও করেন শিয়া ভক্তরা। মনের বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে হোসনি দালানের নিচের নির্ধারিত স্থানে মোমবাতি জ্বালানোর সময় কথা হয় বেশ কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে। তাদের মতে, এখানে মানত বা নিয়ত করে মোমবাতি জ্বালিয়ে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়, অর্থাৎ মনের সব আশা পূরণ হয়। মনের বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে স্মৃতিসৌধ স্বরূপ ইমামবাড়ায় প্রার্থনা করা শরিয়ত সম্মত না হলেও যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী তা করে আসছেন শিয়ারা। তবে হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম এলেই জমজমাট ও কর্মমুখর হয়ে পড়ে হোসনি দালান। মহররমের ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা শহরের মূল আকর্ষণে পরিণত হয় হোসনি দালান। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে সমবেত হয়ে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে মাতম করতে থাকে। আশুরার দিনে অর্থাৎ ১০ মহররমে এখান থেকে বিশাল একটি তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে নগরীর পশ্চিম প্রান্তে প্রতীকীভাবে কারবালা নাম দেওয়া একটি স্থানে গিয়ে শেষ হয়। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর রাত ২টার দিকে আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় হোসনি দালান এলাকায় বোমা হামলা হয়। এতে একজন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। বাংলাদেশে তাজিয়া মিছিলের ওপর হওয়া এটি প্রথম হামলা। যার কারণে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য এরপর থেকে ইমামবাড়াটিকে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়। হোসনি দালান ইমামবাড়াটি শিয়াদের বিশ্বাসের প্রধান স্থাপনা হিসেবে রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি ইমামবাড়া রয়েছে। বিশেষ করে বিহারি ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বসতি যেসব এলাকায় রয়েছে সেসব এলাকায় ইমামবাড়া স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে হোসনি দালানের পাশেই রয়েছে ইয়াকুব ইমামবাড়া, রাজধানীর পল্টনে রয়েছে পল্টন ইমামবাড়া, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরেও রয়েছে আরও কয়েকটি ইমামবাড়া।

সর্বশেষ খবর