শনিবার, ১৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

৬ কোটি টাকায় ল্যাব হলেও বিভাগ অনুমোদন মেলেনি

টেন্ডারে প্রভাব খাটাতে না পেরে মিথ্যাচার করছে ইউজিসি, দুই সদস্যের বিরুদ্ধে নালিশ মন্ত্রীর কাছে

আকতারুজ্জামান

৬ কোটি টাকায় ল্যাব হলেও বিভাগ অনুমোদন মেলেনি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি। নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলা নিয়মিত প্রক্রিয়া হওয়ার কথা হলেও আবেদনের দেড় বছরেও ইউজিসির অনুমোদন পায়নি ‘ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ডাটা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যানালাইটিক্স’ প্রোগ্রাম। এ বিভাগের অনুমোদন চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালে আবেদন করলে দীর্ঘ ১৪ মাস পর গত জানুয়ারিতে সরেজমিন যায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ফলে গত শিক্ষাবর্ষ (২০২০-২১) থেকে এ বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির কথা থাকলেও তা করা যায়নি। অথচ বিভাগ খোলার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টি ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করেছে বিগ ডাটা ল্যাব। গত বছরের মে’তে এ ল্যাব স্থাপন বাবদ ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল ইউজিসি। এ বিভাগের জন্য ছয়টি শ্রেণিকক্ষ থাকার কথাও বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউজিসিকে জানিয়েছিল। উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আইটি খাতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পেশা ক্ষেত্র ডাটা সায়েন্স। এ খাতে বাংলাদেশ এখনো দক্ষ জনবল তৈরিতে তেমন তৎপর নয়। গত জানুয়ারিতে সরেজমিন গিয়ে ইউজিসি প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, এ প্রোগ্রাম চালু করার মতো পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ দেখা যায়নি। এ ছাড়া বিভাগ অনুমোদনের আগে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিগ ডাটা ল্যাব স্থাপন করা কতটা বিধিসম্মত তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে ইউজিসি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলছেন, ইউজিসির চাহিদা অনুযায়ী বিভাগ খোলার যাবতীয় কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়েছিল। বিভাগটি খোলার প্রয়োজনেই বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউজিসি ২০২০-২১ অর্থবছরে বিগ ডাটা ল্যাব স্থাপনের জন্য ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। ইউজিসির বরাদ্দ পেয়ে পিপিআর-২০০৮-এর বিধি মেনে ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এখন এ বিষয়টি নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। আসলে ল্যাব স্থাপনের টেন্ডারে প্রভাব খাটাতে না পেরেই মিথ্যাচার করছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় বিভাগ না দেওয়া, টেন্ডারে ইউজিসি সদস্যদের প্রভাব খাটানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর কাছে অভিযোগ দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ডাটা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যানালাইটিক্স প্রোগ্রাম খোলার জন্য ইউজিসিতে আবেদন করা হয় ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর। একই বছরের ২৮ অক্টোবর প্রোগ্রাম খোলার যৌক্তিকতাসংক্রান্ত বিভিন্ন ডকুমেন্ট চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দেয় ইউজিসি। ইউজিসির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন ডকুমেন্ট পাঠান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর কেটে গেছে ১০ মাস। গত জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে ইউজিসি। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, আবেদনের দীর্ঘ সময় পর ইউজিসি পরিদর্শনে এসে বিভাগ না দিতে নানা অজুহাত দেখিয়েছে। ইউজিসির দুই সদস্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী এ প্রোগ্রাম আটকে রাখার চেষ্টা করছেন। অথচ এর আগে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির সার্কুলার দেওয়ার পর সে বিভাগের অনুমোদন দিয়েছে ইউজিসি।

শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী বরাবর দেওয়া চিঠিতে উপাচার্য মুনাজ আহমেদ নূর উল্লেখ করেন, করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ল্যাব স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছেন। তখন ইউজিসিকে পরিদর্শনে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও তারা আসেননি। ইউজিসি তাদের গাফিলতির দায় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা করছে। ইউজিসির দুই সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে উপাচার্য বলেছেন, ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন টেন্ডারে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন। সে ক্ষেত্রে সফল হতে না পেরে এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিভিন্নভাবে মিথ্যাচার করছেন তিনি। এ ছাড়া সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে অতীতেও দেখা গেছে এ বিশ্ববিদ্যালয় যাতে কাজ করতে না পারে সেজন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। ইউজিসি মিথ্যাচার করে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে উল্লেখ করে এ ব্যাপারে একটি উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠনের অনুরোধ জানিয়েছেন উপাচার্য। বিভাগ খোলার জন্য ইউজিসি প্রতিনিধি দলের আহ্বায়ক ছিলেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের। প্রতিনিধি দলটি বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে গত মাসে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়- বিভিন্ন মাধ্যমে কমিটি নিশ্চিত হয়েছে ল্যাব স্থাপনের কাজ পাওয়া জেভি অব বিএমআইটি সল্যুশনস লি.র স্বত্বাধিকারী কর্তৃপক্ষের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ল্যাব স্থাপনের বিল বাবদ ৫ কোটি ৯৪ লাখ ৬৪ হাজার ২০২ টাকা পরিশোধের ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়- বিল প্রদানের ডেবিট ভাউচারে ৪ কোটি ৬০ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৭ টাকা প্রদান করা হয়েছে। বাকি টাকা কোন প্রতিষ্ঠানের নামে ছাড় করা হয়েছে সে তথ্য দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসির এ পরিদর্শন প্রতিবেদনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর। তিনি গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, ‘ল্যাবের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি আমার ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছে ইউজিসি। আসলে কাজ পাওয়ার আগে এ প্রতিষ্ঠানের কাউকে চিনতাম না আমি। বিল পরিশোধের সব তথ্যও দেওয়া হয়েছিল ইউজিসিকে যা তারা উল্লেখ করেননি। যথাসময়ে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট, ট্যাক্সও জমা দেওয়া হয়েছে। ল্যাব স্থাপনের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি রাখা আছে।’ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে উপাচার্যের অভিযোগের ব্যাপারে ইউজিসি প্রতিনিধি দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. আবু তাহের প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টির বিগ ডাটা ল্যাব পরিদর্শন টিমের আহ্বায়ক থাকলেও আমি এ ব্যাপারে এক্সপার্ট ছিলাম না। কমিটির সদস্য ও সদস্যসচিব পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছেন।’ ‘বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কাজ করতে অতীতেও সমস্যা সৃষ্টির’ উপাচার্যের অভিযোগ সত্য নয় বলে জানান তিনি। ‘টেন্ডারে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে সফল হতে না পেরে মিথ্যাচার করছেন’, উপাচার্যের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘উপাচার্য কেন আমার ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন তা আমার বোধগম্য নয়। এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’ উপাচার্যের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর