শনিবার, ১৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বিদ্যুৎসৃষ্ট দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

ওভারলোডিং, শর্টসার্কিট, বৈদ্যুতিক ছেঁড়া তারে স্পৃষ্ট হয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা

জিন্নাতুন নূর

বিদ্যুৎসৃষ্ট দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

দেশে বিদ্যুৎসৃষ্ট দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকির হার বাড়ছে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট উদ্ভূত অগ্নিকাণ্ড বা বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যে, ২০২১ সালে দেশের মোট অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনার শতকরা প্রায় ৩৭ শতাংশই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ বা শর্টসার্কিটের কারণে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, দগ্ধ হয়ে প্রাণহানির প্রায় অর্ধেক ঘটছে বিদ্যুৎসৃষ্ট দুর্ঘটনায়। সম্প্রতি বৈদ্যুতিক কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনার হারও আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই ধরনের দুর্ঘটনায় শুধু করুণ মৃত্যুই ঘটছে না, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির অঙ্গহানির পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে বিপুল অর্থ-সম্পদের। বিশেষজ্ঞরা দুর্ঘটনা রোধে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ এবং এসিসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে মোট ৭ হাজার ৯৫৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। যা ছিল সে বছর মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৬.৮২ শতাংশ। এতে ক্ষতি হয় ১৩১ কোটি ৭ লাখ ৪২ হাজার ৯৫১ টাকা। এ ছাড়া স্থির বিদ্যুতের কারণে মোট ৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষতি হয় ৯০ হাজার টাকা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো সাধারণত অফিস, মার্কেট, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই বেশি ঘটে। আর বাসাবাড়ি ও কর্মস্থলে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অসাবধানতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ওভারলোডিং ও শর্টসার্কিট এবং অসচেতনতা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্রাহকরা যে সকেট, মাল্টিপ্লাগ ও এসি ব্যবহার করছেন সেগুলো তারা কম দামে কিনছেন। এগুলোর গ্যারান্টিও থাকে না। আর নিম্নমানের এই পণ্যের ব্যবহারের জন্য শর্টসার্কিট, এসি বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। দেখা যায় যে, প্রতিবছর শীত শেষ হলে মানুষজন এসি ব্যবহার শুরু করেন কিন্তু ব্যবহারকারীদের অনেকেই এই যন্ত্রটি প্রতি বছর সার্ভিসিং করান না। এটা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এখন নতুন নতুন শিল্পকারখানা তৈরি করা হচ্ছে আর সেখানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে যা কি না বিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সেখানেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক ছেঁড়া তার থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।

২০০৩ সালের অগ্নিনির্বাপণ আইন অনুযায়ী ছয় তলার ওপর কোনো ভবন অথবা কোনো শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক কারখানা, অফিস নির্মাণ করতে হলে এর অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে যেহেতু ২০০৩-এর আগে এ সংশ্লিষ্ট কোনো আইন ছিল না এ জন্য কেউ সে সময় ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সেফটি মানেননি। অর্থাৎ ২০০৩ এর আগে যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল সেগুলো ফায়ার সেফটি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়। আবার বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে অগ্নিসুরক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত দেওয়া আছে। আর এটিও তৈরি হয় ২০০৬ এ। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার ভবনগুলো অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে তৈরি করা হয়নি। আর এই ভবনগুলোতে বৈদ্যুতিক কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেশি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ’৯০-এর দশকে ঢাকায় যেসব ভবন উঠেছে সেগুলো শুধু ফ্যান ও লাইট চালানোর উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল। তখন ঘরে ঘরে এখনকার মতো এসি ছিল না। অর্থাৎ ’৯০ এর দশকে ভবনের যে ওয়্যারিং সিস্টেম করা হয় তা ফ্যান ও লাইট চালানোর মতো উপযোগী করে তৈরি করা হয়। কিন্তু এখন ঘরে ঘরে এসি লাগানোয় ক্ষমতার অতিরিক্ত লোড ওয়্যারিং সিস্টেমকে নিতে হচ্ছে। এ থেকে শর্টসার্কিটের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণ পোড়া রোগীর তুলনায় বৈদ্যুতিক কারণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পোড়া রোগীর ক্ষত অনেক বেশি। পাঁচ বছর ধরে লক্ষ্য করে দেখছি যে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দুর্ঘটনা খুব ‘কমন’ হয়ে গিয়েছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বিস্ফোরিত হচ্ছে।

এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে একটি নির্দিষ্ট আইন করতে হবে। বছর বছর এসি সার্ভিসিং যিনি করবেন না তার যন্ত্রটি বাতিল বা তাকে জরিমানা করার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ঘটনা রোধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়া সাধারণ মানুষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর