সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ঢাকার বাস টার্মিনাল সরবে কবে

এক যুগের অপেক্ষা, নগরজুড়ে দূরপাল্লার বাসস্টপেজ, বাড়ছে যানজট

শিমুল মাহমুদ

ঢাকার বাস টার্মিনাল সরবে কবে

রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘিরে যানজট লেগেই থাকে -রোহেত রাজীব

রাজধানীর চারটি বাস টার্মিনাল নগর কেন্দ্র থেকে বাইরে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি। বারবার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু বাস টার্মিনাল সরে না। অন্যদিকে অপরিকল্পিত বাস টার্মিনালগুলোর কারণে রাজধানীর যানজট বাড়ছে। টার্মিনাল উপচে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে দূরপাল্লার বাস। প্রায় ২ কোটি মানুষের এই রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির বিস্তার, অপর্যাপ্ত গণপরিবহন এবং পার্কিং নৈরাজ্যের কারণে শহরের মাঝখানে ঠাঁই নেওয়া বাস টার্মিনালগুলো শহরতলিতে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে চারটি টার্মিনালের স্থান নির্বাচন শেষ। জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। সবকিছু শেষ করে পুরোপুরি টার্মিনাল স্থানান্তর করতে আরও দুই বছর সময় লেগে যাবে। এ জন্য প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা শহরের গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে দূরপাল্লার বাসগুলোর জন্য বিরুলিয়া, সাভারের হেমায়েতপুর, কেরানীগঞ্জের বাঘাইর ও কাঁচপুরে চারটি বাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ চারটি জায়গায় আন্তজেলা বাস টার্মিনাল নির্মিত হলে ঢাকা শহরের ওপর থেকে যানবাহনের চাপ কমে যাবে এবং সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনালকে সিটি টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এ নিয়ে সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘বাস রুট  রেশনালাইজেশন’ কমিটির ১৫তম সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ডিএসসিসির মেয়র এবং বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এতে উপস্থিত ছিলেন বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। বৈঠক শেষে দুই মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, সাভারের হেমায়েতপুরে একটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল করা হবে। দক্ষিণাঞ্চলের জন্য কেরানীগঞ্জের বাঘাইরে একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং আরেকটি জায়গা কাঁচপুরে নির্ধারণ করা হয়েছে। চারটি জায়গায় আন্তজেলা বাস টার্মিনাল স্থাপন করলে ঢাকা শহরের ওপর থেকে চাপ কমবে। সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনালকে আমরা সিটি টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারব। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে রাজধানীর চারটি বাস টার্মিনাল স্থানান্তরের প্রথম উদ্যোগ নেয়। এরপর বারবার আলোচনায় এসেছে এই টার্মিনাল স্থানান্তর। কিন্তু গত এক যুগে কাজ এগিয়েছে সামান্যই। উল্টো রাজধানীর বিদ্যমান টার্মিনাল ঘিরে যাত্রী দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েক গুণ। টার্মিনালকেন্দ্রিক নানা অপরাধও বেড়েছে। বাস টার্মিনাল স্থানান্তর না হওয়ায় টার্মিনালগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে যানজট। মহাখালী টার্মিনালের যানবাহনের কারণে মহাখালী থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সড়কের যানজট বাড়ছে। এই রুটে চলাচলকারী মোট যানবাহনের অন্তত ২০ শতাংশ মহাখালী টার্মিনাল ব্যবহারকারী দূরপাল্লার বাস। টার্মিনালটি সরিয়ে নেওয়া হলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের যানজট অনেক কমে যাবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

জানা গেছে, রাজধানীকে ভয়াবহ যানজটের কবল থেকে মুক্ত রাখতে ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল কেরানীগঞ্জে, মহাখালী টার্মিনাল টঙ্গীতে, সায়েদাবাদ টার্মিনাল কাঁচপুরে ও গাবতলী টার্মিনাল বিরুলিয়ায় স্থানান্তরের জন্য ২০১০ সালের ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক হয়। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নির্দেশ  দেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি)। পরে ওই বছরের ১২ আগস্ট ডিসিসি চারটি টার্মিনালের জন্য রাজউককে ৮০ একর জমি দেওয়ার অনুরোধ করে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ নগরীর মাঝখানের চারটি বাস টার্মিনাল। এসব এলাকায় সর্বক্ষণ রাস্তার ওপর অসংখ্য গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। ফলে সর্বক্ষণ যানজটও লেগে থাকে। এসব টার্মিনাল রাজধানীর প্রান্তসীমায় না নিলে মহানগরীর যানজট বাড়তেই থাকবে। যানজট সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।

নগর বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ঢাকায় ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপ এবং নগর বিস্তৃতির কারণে চারটি বাস টার্মিনাল এখন রাজধানীর মাঝখানে এসে পড়েছে। ফলে পর পর সাতটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করার পরও আশানুরূপ ফল মিলছে না। একই কারণে হানিফ ফ্লাইওভারের সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না। হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান পয়েন্টেই রয়েছে জয়কালী মন্দির টার্মিনাল। ওখান থেকে কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মাওয়াসহ বেশ কয়েকটি গন্তব্যের বাস ছাড়ে। এতে ওই স্থানেও সর্বক্ষণ যানজট  লেগে থাকে। ফলে ফ্লাইওভারে গাড়িগুলোকে উঠতেও যেমন যানজটে পড়তে হয়, নামতেও যানজট লেগে যায় ফ্লাইওভারের ওপর। অন্যদিকে বাস টার্মিনাল সরানোর পাশাপাশি রাজধানীর ভিতর বাসের কাউন্টারগুলোর সামনে থেকে দূরপাল্লার বাসের যাত্রী তোলা বন্ধ করতে হবে। আবদুল্লাহপুর, মিরপুর, কল্যাণপুর, কলাবাগান, কমলাপুর, আরামবাগ, ফকিরাপুলসহ রাজধানীর অসংখ্য স্থানে গড়ে উঠেছে দূরপাল্লার বাসস্টপেজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্লিপ্ততার সুযোগে নগরজুড়েই এখন টার্মিনাল। এসব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে টার্মিনাল সরিয়েও কোনো কাজ হবে না বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।  

উল্লেখ্য, ঢাকার যোগাযোগ খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) ছয়টি নতুন আন্তজেলা বাস টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় অনেক ক্ষেত্রেই আরএসটিপি অনুসরণ করা হয়নি। যানজট কমাতে ঢাকা শহরের বাইরে বাস টার্মিনাল স্থানান্তরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক খাতেই প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা লাগবে। লোকাল বাস ও ট্রাক টার্মিনাল রাজধানীর বাইরে নিতে ডিপো নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে খরচ আরও বাড়বে।

বর্তমানে গাবতলী টার্মিনালে ২২ একর, মহাখালীতে ৯ একর এবং সায়েদাবাদে ১০ একর জমি রয়েছে। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন বাঘাইরে ৩৩ দশমিক ৬৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সাভারের হেমায়েতপুরে ৪৫ একর, বিরুলিয়ার ভাটুলিয়ায় ২৬ দশমিক ৭ একর, কাঁচপুর দক্ষিণে ২৬ দশমিক ৭ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে টার্মিনাল নির্মাণে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, রাজধানীর ভিতর থেকে চারটি বাস টার্মিনাল সরানোর ব্যাপারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা যে স্থান নির্বাচন করেছি, সেখানে সরকারের হাতে জমি বেশি নেই। বাকি জমি নিতে হবে বেসরকারি খাত থেকে। সেটা অধিগ্রহণের চেষ্টা চলছে। এসব জমির অধিকাংশই নিচু জমি। সেগুলো ভরাট করতে হবে। মাটির বসার জন্য সময় দিতে হবে। আশা করি, সর্বোচ্চ দুই বছরের আমরা মধ্যে টার্মিনাল সরানোর কাজ শেষ করতে পারব।

সর্বশেষ খবর