সোমবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দশ বছরেও নেই অগ্রগতি

আকতারুজ্জামান

দশ বছরেও নেই অগ্রগতি

দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। ৩০ বছরের ব্যবধানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ১০৯টি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তার ঘটলেও গুণগত মানে তেমন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে- গত ১০ বছরেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। বরং অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে! গবেষণায় অনীহা, সনদ-বাণিজ্য, অনুমোদনহীন শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা, ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্বসহ অনেক সমস্যাতেই জর্জরিত কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের পর বছর আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়া স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৬০টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ছিল ৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৪০ জন। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্র-ছাত্রী ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭ জন। সে হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৮টি বাড়লেও মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা না বেড়ে বরং কমেছে। উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বিদেশি শিক্ষার্থী থাকলেও সে আগ্রহেও ভাটা পড়েছে। দেখা গেছে, ২০১২ সালে বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী ছিল ১ হাজার ৬৪২ জন। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৭৭ জন। কিন্তু ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, বছরটিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ১ হাজার ৬০৪ জন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার নিম্নমান, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় আন্দোলনে জড়ানো ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ঢুকে যাওয়ায় বিদেশিদের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্রহ কমছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ ছাড়া ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গড় হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০২১ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করেছে ৮৫ হাজার ২০২ টাকা। অথচ ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৪৩০ টাকা। বছর বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিউশন ফি বাড়ালেও অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক চিত্র দেখা গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর আড়াই যুগ পার হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খন্ডকালীন শিক্ষকের ওপর নির্ভর করছে। ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খন্ডকালীন শিক্ষক ছিল ৩ হাজার ৩১১ জন। খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কারণে যখন-তখন ছাঁটাই, বেতন কম দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে হরহামেশা। ফলে মেধাবীরাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ দেখান না। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত গড় হিসাবে সন্তোষজনক (একজন শিক্ষকের বিপরীতে ২০) হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কাক্সিক্ষত মানে ছিল না। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স, এনপিআই ইউনিভার্সিটিসহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম তথা শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি ও দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা। এসবের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই বৈধ কোনো কর্তৃপক্ষ বা ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যা দূর করতে অন্তত একবার সভার আয়োজন করবে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। কিন্তু বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এক বছরে একবারও গুরুত্বপূর্ণ এই কমিটির কোনো বৈঠকই করেনি। এর মধ্যে রয়েছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া এক বছরেও অর্থ কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাবিদরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ কমিটির এক বছরেও বৈঠক না হওয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মের ব্যত্যয় হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, অনেক আগ থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সনদ-বাণিজ্য, ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব, যোগ্য শিক্ষক না থাকাসহ অনেক সমস্যা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বর্তমানে ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অথচ মানের দিক দিয়ে চিন্তা করলে ২০ থেকে ২৫টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা উচিত নয়। এ শিক্ষাবিদ বলেন, এখন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অনেক সচেতন। তারাও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করছেন। কারণ তারা জানেন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অর্জিত সনদের কোনো মূল্য নেই। আর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। ইউজিসি প্রাণপণ চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়মের মধ্যে রাখতে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সময়মতো সহযোগিতা না পাওয়ায় এটি সব সময় সম্ভব হয় না। আর মন্ত্রণালয়েরও এ ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাব রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ইউজিসির ক্ষমতায়ন বা শিক্ষাবিদদের নেতৃত্বে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন করার পক্ষে মত দেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর