বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

উৎস রোধে নেই কার্যকর পদক্ষেপ

♦ বায়ুদূষণ বন্ধে মানা হচ্ছে না উচ্চ আদালতের নির্দেশ ♦ পুড়ছে টায়ার, হচ্ছে ব্যাটারি রিসাইক্লিং ♦ ঢাকার চারপাশে চলছে অবৈধ ইটভাটা ♦ যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী থেকেও হচ্ছে দূষণ

জিন্নাতুন নূর

উৎস রোধে নেই কার্যকর পদক্ষেপ

বাংলাদেশে বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় তিনটি উৎস হচ্ছে- অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, যানজট এবং ইটের ভাটা। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও এগুলো নিয়ন্ত্রণে সেই অর্থে সফলতা আসেনি। বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতরের ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ শীর্ষক প্রকল্পেও অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার উচ্চ আদালত রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে যে নয়টি নিদের্শনা দিয়েছেন সেগুলোরও কোনো বাস্তবায়ন নেই। ঢাকার চারপাশে গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটায় প্রতিনিয়ত মারাত্মক দূষিত হচ্ছে বায়ু। এ ছাড়া মহানগরীর যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত ফেলে রাখায় বায়ুদূষণ কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ রোধে এর বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা দুর্বল। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কঠোর ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও কার্যত তা নেই।

বায়ুদূষণ রোধে বিশ্বব্যাংকের ঋণে ২৮৪ কোটি টাকার ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ নামের প্রকল্প (কেইস) গ্রহণ করে পরিবেশ অধিদফতর। কিন্তু এ প্রকল্পে পরিবেশ উন্নয়ন তথা মানুষ কোনো সুফল পেয়েছে এমনটি জানা নেই। প্রকল্পে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিদেশ সফর ও প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সই জালিয়াতির খোঁজ পেয়েছে এ কমিটি। উচ্চ আদালত রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে রয়েছে যেসব পরিবহনের ইকোনমিক লাইফের মেয়াদ শেষ হয়েছে সেসব পরিবহনের চলাচল নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। রাজধানীতে চলাচলকারী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বাস ও যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় বায়ু বিপজ্জনকভাবে দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া টায়ার পোড়ানো ও ব্যাটারি রিসাইক্লিং বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হলেও এখনো দেদার টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং কাজ চলছে। এ বিষয়ে পরিবেশবিদ ড. আতিক রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বায়ুদূষণ বলতে এখন যা দেখতে পাচ্ছি সেটি আসলে ধুলো এবং অতি ক্ষুদ্র কণা যা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। শহরে যে ধুলো উড়ে বেড়াচ্ছে তা বৃষ্টি বা পানির মাধ্যমে সরানোর কোনো উপায় নেই। ঢাকার আশপাশে আমাদের নদীগুলোও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এর ফলে ধুলো আটকানোর মতো কোনো ব্যবস্থাও এখন নেই। এতে বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে।’

ঢাকার পাশের চার জেলা গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে রয়েছে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা যা বন্ধ করা যায়নি। বস্তি এলাকায় রান্নাঘরে কাঠ পুড়িয়ে যে রান্না হচ্ছে তার কিছু কয়লা হয় কিছু হয় ধুলো। এভাবে ঢাকায় ধুলো তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে শহরের বালু, ময়লা ও বর্জ্য বহনকারী ট্রাকসহ সংশ্লিষ্ট যানবাহনগুলো ঢেকে চলাচল করার কথা থাকলেও তা কার্যত মানা হচ্ছে না। যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ এলাকায় বালু, সিমেন্ট ও মাটিসহ নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। যত্রতত্র সিমেন্ট, বালু ও ইটের টুকরোর গুঁড়া বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ুদূষণ করছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ধূলিপ্রবণ এলাকাগুলোতে পানি ছিটানোর নির্দেশনা রয়েছে কিন্তু মাঝে-মধ্যে হাতেগোনা কিছু এলাকায় পানি ছিটালেও বাকি এলাকাগুলো দিন-রাতে ধুলোবালি উড়তে দেখা যায়। সরেজমিন ঢাকার বিভিন্ন প্রধান সড়ক ও পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায় শহরজুড়ে চলমান মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ফ্লাইওভার নির্মাণসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত কাজের জন্য রাস্তার ওপর পড়ে থাকা নির্মাণসামগ্রী থেকে বায়ুদূষণ হচ্ছে। ফলে দিনের বেলাতেও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র ধুলোবালিতে কুয়াশার মতো ঘোলাটে অবস্থা তৈরি হচ্ছে। পথচারীদের অনেকেই অভিযোগ করেন, শহরজুড়ে চলমান উন্নয়ন কাজের ফলে সৃষ্ট ধুলোবালিতে তাদের চলাফেরায় সমস্যা হচ্ছে। এমনকি নগরীর বিভিন্ন এলাকার প্লটে প্লটে যে নির্মাণকাজ হচ্ছে সেগুলোও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনহীনভাবে চলছে। এর ফলে সৃষ্ট দূষণরোধে পরিবেশ অধিদফতর ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকা নেই।

এ বিষয় নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের যত ধরনের ভবন নির্মাণের উপাদান আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ তৈরি করে ইট। এর বানানো থেকে পরিবহন এবং প্রক্রিয়াকরণ সব পর্যায়ে দূষণ তৈরি হয়। সিটি করপোরেশন প্রতিদিন সকালে শুকনো ধুলো বা বর্ষার পর সড়কে থাকা কাদা যা ধুলোয় পরিণত হয়। এগুলোতে পানি ব্যবহার না করে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। ফলে নগরী ধুলোয় ধূসরিত হয়। আবার সিটি করপোরেশনের কর্মীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্জ্য না ঢেকেই তা পরিবহন করে। একইভাবে আমাদের নির্মাণসামগ্রী যেমন- বালু, সিমেন্ট এবং ইটও উন্মুক্তভাবে পরিবহন করি। ফলে বিরাট দূষণের ঘটনা ঘটে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর