শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডাবল মার্ডারের রোমহর্ষক কাহিনি

♦ সড়ক দুর্ঘটনা নয় নিখুঁত কিলিং মিশন ♦ দুবার ব্যর্থতার পর তৃতীয় দফায় সফল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডাবল মার্ডারের রোমহর্ষক কাহিনি

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী এলাকায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী শাহন শাহ আলম বিপ্লব (৩৪) ও মো. মনির হোসেন (৩৪) নিহত হন। অন্য দুর্ঘটনার মতো, এই ঘটনাতেও মামলা হয়। তদন্ত শেষে এটিকে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখ করে মাইক্রোবাস মালিককে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্রও দেয় হাইওয়ে পুলিশ। কিন্তু পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে আসে ঘটনার পেছনের রহস্য। পরিকল্পিতভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতেই মাইক্রোবাসে ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীদের হত্যা করা হয়।

পিবিআই বলছে, যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ঘাতক চালক পালিয়ে গেলেও যাত্রীরা পালিয়ে যান না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো যাত্রীকে পাওয়া না যাওয়ায় সন্দেহ হয় তদন্তকারীদের। এরপর চালককে গ্রেফতারের পর অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ঘটনার সঙ্গে নয়জনের সংশ্লিষ্টতা। যাদের চারজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- মো. মাসুম মিয়া, সোহাগ মিয়া, মাসুদ মিয়া ও মামুন মিয়া। এদের মধ্যে তিনজন হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ২০২১ সালের ১২ আগস্ট নরসিংদীর শিবপুর থানা এলাকায় মহাসড়কের ওপর মাইক্রোবাসের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। এ ঘটনায় দায়ের মামলায় মাইক্রোবাস মালিক মাসুম মিয়াকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় হাইওয়ে পুলিশ। এ তদন্তে নিহত বিপ্লবের ভাই সোহাগ মিয়া নারাজি দেন এবং আরেকটি সিআর মামলা করেন। হাইওয়ে পুলিশের মামলাটির সঙ্গে সিআর মামলাটিকে যুক্ত করে অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআই নরসিংদী জেলাকে। পরে পিবিআইয়ের তদন্তে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বেরিয়ে আসে। পিবিআই প্রধান বলেন, নিহত শাহান শাহ আলম বিপ্লব একাধিক হত্যা মামলার আসামি ও মনির হোসেন তার বডিগার্ড। বিপ্লব এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করলেও কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। এক সময় বিপ্লবের সঙ্গে ডিশ ব্যবসা করা মামুন মিয়াই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ইতোপূর্বে দুবার হত্যা চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয় মামুন। সবশেষে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে মাইক্রোবাস চাপা দিয়ে হত্যা করা হয় বিপ্লব ও তার বডিগার্ডকে। তদন্তে পিবিআই জানতে পারে, ২০১৯ সালে দুলাল গাজী নামে একজনকে রায়পুরা লোচনপুর বাজারে জবাই করে হত্যা করা হয়। যার প্রধান আসামি ছিলেন বিপ্লব। বিপ্লবের বিরুদ্ধে ৪টি হত্যাসহ ১০টি মামলা ও ১১টি গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। দুলাল গাজী হত্যা মামলায় পিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন বিপ্লব। বিপ্লব জেল থেকে জামিনে বের হয়ে ওই মামলায় সাক্ষী জুয়েল ও নাঈমকে এলাকায় ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এমনকি পিবিআইয়ের যে কর্মকর্তা বিপ্লবকে গ্রেফতার করেছিল তার বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দফতরে অভিযোগ করেন বিপ্লব। পরে অভিযোগটি জেলা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেয় পুলিশ সদর দফতর। বিপ্লব ও তার সঙ্গীদের এমন কর্মকাণ্ডে এলাকার অনেকে ক্ষিপ্ত হয়। এর মধ্যে এক সময় বিপ্লবের সঙ্গে ডিশের ব্যবসা করা মামুন মিয়া বিপ্লবকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

গ্রেফতারকৃতদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পিবিআই জানায়, ঘটনার দিন প্রথমে লোচনপুর থেকে তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ নরসিংদী রওনা করে। পথে বারৈচা থেকে কালো মাইক্রোবাসটি সংগ্রহ করে। তথ্য সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য সোহাগ ও ফয়সাল নরসিংদীতে আসেন। সোহাগ ও ফয়সাল ভিকটিম বিপ্লবের সার্বক্ষণিক মুভমেন্ট ফলো করে জানাতে থাকেন। পিবিআই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা বিপ্লবের অভিযোগটির তদন্তে সেদিন বিপ্লবকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডাকা হয়। এসপি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে বিপ্লব মনিরের মোটরসাইকেলে উঠেন। বিপ্লব ও মনির মোটরসাইকেলে করে হাইওয়েতে উঠলে সোহাগ তাৎক্ষণিক তথ্য জানিয়ে দিলে হত্যার উদ্দেশে আসামিরা ভিকটিম দুজনকে অনুসরণ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিপ্লবের মোটরসাইকেলটি তাদের মাইক্রোবাস ক্রস করার সময় পেছন থেকে পরিকল্পিতভাবে ধাক্কা দেয় এবং ঘটনাস্থলেই বিপ্লব ও মনির নিহত হয়। হত্যাকাণ্ডের পেছনে অর্থদাতা হিসেবে ওমর ফারুক মোল্লা নামে এক প্রবাসীর নাম উঠে এসেছে। তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনুসন্ধান চলছে। পিবিআই কর্মকর্তা বনজ কুমার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মামলাটি তদন্তে নেমে পিবিআই জানতে পারে কথিত দুর্ঘটনার আগে মাইক্রোবাসে যাত্রী থাকলেও দুর্ঘটনার পর যাত্রীদের পাওয়া যায়নি। এরপর জানা যায়, ঘটনাটি মহাসড়কে ঘটলেও এর পেছনে ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমে মাইক্রোবাস মালিক মাসুম মিয়াকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে তার দেওয়া তথ্যে বাকি তিনজন মামুন, সোহাগ ও মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়।

সর্বশেষ খবর