শনিবার, ৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সুলতানি আমলের দুর্লভ নিদর্শন নড়াইলে

সাজ্জাদ হোসেন, নড়াইল

সুলতানি আমলের দুর্লভ নিদর্শন নড়াইলে

নড়াইল সদর উপজেলার হবখালী ইউনিয়নের নয়াবাড়ি গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সন্ধান মিলেছে প্রায় ৭০০ বছর আগের প্রাচীন পুরাকীর্তি। এরই মধ্যে খননকাজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রাচীন আমলের অলঙ্কৃত ইট, মৃৎ তৈজসপত্র, ইটের প্রাচীর ও সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ। এ নিদর্শন সুলতানি আমলের কোনো এক পাতালভেদি রাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, খননে ইটের আকার ও কারুকার্য, স্থান এবং আশপাশের ভৌগোলিক কাঠামো দেখে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, এটি আদি ঐতিহাসিক মুসলিম সুলতানি আমলের নিদর্শনের কোনো প্রত্নস্থান। আরও খনন করলে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। এদিকে খনন কাজ শুরুর পর থেকে দুর্লভ এ পুরাকীর্তিকে ঘিরে স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন প্রত্ননিদর্শন দেখতে। প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নড়াইল জেলায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের পরিচালিত জরিপে নয়াবাড়ি গ্রামের এ প্রত্নস্থানটি অনুসন্ধানের জন্য চিহ্নিত করা হয়। এরপর গত বছর জুনে প্রত্ন্নতত্ত্ব অধিদফতরের পুরাকীর্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে অনুযায়ী অধিদফতরটির আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় খুলনা ও বরিশাল বিভাগ চিহ্নিত স্থানে এবার পুরাকীর্তির অনুসন্ধানে খনন কাজ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ এপ্রিল থেকে এ অনুসন্ধান অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। আট সদস্যের এ অনুসন্ধান দলের সরেজমিন নেতৃত্ব দেন সহকারী পরিচালক মো. গোলাম ফেরদৌস। তাদের এ অনুসন্ধানকালে কয়েকটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের অনুসন্ধান মিলেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর জানিয়েছে, সদর উপজেলার নয়াবাড়ি গ্রামে ৩২ একর জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব প্রত্ন নিদর্শন। মাটি খুঁড়তেই একে একে বেরিয়ে আসছে মুঘল আমলের স্থাপত্যের বিভিন্ন নিদর্শন। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে সেই আমলের সিঁড়ি, আবার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে প্রাচীর। গভীরভাবে খনন করলে হয়তো হারিয়ে যাওয়া আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জনশ্রুতি আছে, এক সময় এ জায়গায় বসত করতেন এক পাতালভেদি রাজা। ষষ্ঠ শতকে এখানে তাদের বসবাস ছিল বলে ধারণা স্থানীয়দের। নড়াইল শহর হতে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে নবগঙ্গা নদীর তীরে সদর উপজেলার হবখালী ইউনিয়নে নয়াবাড়ি গ্রামের আফছার শেখ ও ছাত্তার মোল্যাসহ কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ জানান, ‘আমরা প্রায় অর্ধশত বছর আগেও দেখেছি এখানে গভীর জঙ্গল ছিল। রাত এমনকি দিনের বেলায়ও ভয়ে এখানে কেউ আসত না। এখানে বিশাল বিশাল গাছ ছিল। এর চারপাশে বড় দীঘি ছিল। পূর্ব পুরুষদের নিকট থেকে শুনেছি, এ রাজার রাজপ্রাসাদ শত্রুমুক্ত রাখতে চারদিকে বিশাল দীঘি খনন করা হয়। এ ছাড়া এখানে একটি গভীর পুকুর ছিল, যার নাম ছিল দুধপুকুর। রাজা তাঁর ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন সময় দুধ দিয়ে এ পুকুরে স্নান করাতেন। এ দুধ পুকুরের পাশেই একটি সুড়ঙ্গ পথ ছিল। রাজা ও তার পরিবার বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে দুর্গবাড়ির পূর্বে নবগঙ্গা নদীর ঘাট পর্যন্ত আধা কিলোমিটার চুনসুরকির গাঁথুনি বিশিষ্ট ইটের খিলান দ্বারা ভূগর্ভস্থ প্রাচীন এক সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করেছিলেন, যে পথ দিয়ে রাজ দরবারের লোকজন যাতায়াত করতেন। কিছুকাল আগেও আমরা দেখেছি এ রাজবাড়ি থেকে এ গ্রামের মানুষ ইচ্ছামতো ইট নিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন।’

খনন কাজের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. গোলাম ফেরদৌস জানান, ‘উদ্ধার হওয়া প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন দেখে ধারণা করা হচ্ছে এটি অন্তত ৭০০ বছর আগের কোনো স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ হতে পারে। মাটির নিচে কোনো বিলুপ্ত স্থাপনা আছে কি না তা চিহ্নিত করার উদ্দেশ্য পরীক্ষামূলক যে খনন কাজ এখানে করা হয়েছে- তাতে শতভাগ সফলতা এসেছে। এরই মধ্যে মুঘল আমলের বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা অনুমান করছি এর নিচে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ আছে। এর জন্য আরও গভীরভাবে খনন প্রয়োজন। নড়াইল জেলার ইতিহাস পুনর্গঠনে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর