বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

চারজনে একজনের ফ্যাটি লিভার

জয়শ্রী ভাদুড়ী

চারজনে একজনের ফ্যাটি লিভার

মাস দুয়েক ধরে পেটে ব্যথা অনুভব করছিলেন উত্তরার বাসিন্দা শারমিন বেগম। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হাসপাতালে চিকিৎসককে দেখালে তিনি আল্ট্রাসনোগ্রাম ও রক্তের কিছু পরীক্ষা দেন। শারমিন বেগম বলেন, রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসককে দেখালে তিনি জানান আমি ফ্যাটি লিভারের সমস্যায় ভুগছি। চিকিৎসক আমাকে শুধু কিছু ওষুধ দেন। এ ছাড়া পরিমিত খাবার, নিয়মিত হাঁটা কিংবা ব্যায়ামের কোনো পরামর্শ দেননি। এ ওষুধ খাওয়ার পরে বাধে বিপত্তি। আমার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দেয়। একসময় মলের সঙ্গে রক্ত আসা শুরু হয়। এতে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। পরে ওই হাসপাতালেরই অন্য চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানান, ওষুধের কারণে এ পরিস্থিতি হয়েছে। ওষুধের কারণে সৃষ্ট কোষ্ঠকাঠিন্যে মলদ্বারের স্নায়ু ও মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রক্ত বের হচ্ছে। সবকিছু শুনে ওই চিকিৎসক কোনো ওষুধ না দিয়ে পরিমিত খাবার ও ব্যায়ামের বেশ কিছু পরামর্শ দেন। বিশেষ করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫ মিনিট হাঁটতে বলেন। শারমিন বলেন, এক রোগের চিকিৎসা করাতে এসে আমি আরও জটিল সমস্যায় পড়ে গেছি। শুধু শারমিন বেগম নন, দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ ফ্যাটি লিভারের সমস্যায় ভুগছেন। প্রাথমিক অবস্থায় যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও লিভার রোগ সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রতি চারজনের একজন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। ফ্যাটি লিভার মানে যকৃতে চর্বি জমে যাওয়া এবং যকৃৎ একটু বড় হয়ে যাওয়া। ফ্যাটি লিভারের একটি বিপজ্জনক পরিণতি হলো ‘নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস’ (সংক্ষেপে ন্যাশ)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের অধ্যাপক ডা. মামুন-আল-মাহতাব স্বপ্নীল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাশ্চাত্যে ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ অ্যালকোহল। তবে আমাদের মতো দেশগুলোয় মেদভুঁড়ি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, হাইপারটেনশন বা অতিরিক্ত রক্তচাপ আর হাইপো-থাইরয়েডিজম ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শহর এলাকায় আমরা প্রায়ই ফ্যাটি লিভারের রোগীদের দেখা পাই। আশঙ্কাজনকহারে এখন গ্রামেও রোগী বাড়ছে। আমাদের এক গবেষণায় দেখেছিলাম, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের পর ফ্যাটি লিভারই এ দেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ। কিন্তু কভিড-১৯-এর পর ফ্যাটি লিভার প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। এ দেশে প্রায় ৫ শতাংশ লিভার সিরোসিস রোগী ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এ থেকে লিভার সিরোসিস হলে, ১৫ শতাংশ রোগী সাত বছরের মধ্যে আর ২৫ শতাংশ ১০ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের খাদ্য তালিকা ভাতনির্ভর হওয়ায় অতিরিক্ত শর্করা শরীরে গিয়ে ফ্যাটিলিভার তৈরি করে। তাই খাদ্য তালিকা ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। ভাত খেয়ে ঘুমাতে যাওয়া যাবে না, কমপক্ষে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। চা, কফিতে চিনি খাওয়া, মিষ্টি খাওয়া কমাতে হবে। নিয়মিত হাঁটা ও শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে জীবযাপনে পরিবর্তন আনলে ঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।’

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা এনএইচএস বলছে, যকৃতে কিছুটা চর্বির উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একজন ব্যক্তির যকৃতের যে ওজন, তার ১০ শতাংশের বেশি যদি চর্বি হয় তখন সেটিকে ফ্যাটি লিভার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংস্থাটি বলছে, যাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি, বিশেষ করে যাদের শরীরের মাঝখানের অংশে, পেটে অনেক চর্বি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে। এ ধরনের ব্যক্তিদের শরীরকে আপেলাকৃতির শরীর হিসেবে বর্ণনা করেছে এনএইচএস। এ ছাড়া যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, থাইরয়েডের সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারি রয়েছে তাদের ঝুঁকি বেশি। কিন্তু এসব অসুখ নেই এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ছে। এমনকি শিশুদের মধ্যেও এটি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছে এনএইচএস। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও বাড়ছে ফ্যাটিলিভার আক্রান্তের সংখ্যা। সম্প্রতি ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলায় শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে ২৩ শতাংশ নারী ও ২০ শতাংশ পুরুষের মধ্যে ফ্যাটি লিভার পাওয়া গেছে। শহরে এর প্রবণতা ৩০ শতাংশের মতো।

সর্বশেষ খবর