রবিবার, ৪ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

পুকুর দখলের মহড়া

কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না, দাবি পরিবেশবাদীদের

হাসান ইমন

পুকুর দখলের মহড়া

রাজধানীতে জলাভূমির তীব্র সংকট। একটি আদর্শ শহরে জলাভূমি থাকা প্রয়োজন ১০-১২ শতাংশ। অথচ ঢাকায় আছে মাত্র ২.৯ শতাংশ। গত ১০০ বছরে রাজধানী থেকে ৯৬টি পুকুর হারিয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার দখলের মহড়ায় পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় ডিআইটি পুকুর। পুকুরটি দখল করে সেখানে দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে একটি চক্র। একই সঙ্গে এখনো চলছে ভরাট ও দখলের মহাউৎসব। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গেন্ডারিয়া পুকুরের চারপাশ মার্কেট ও কংক্রিটের দোকানে ঘেরা। এমনভাবে দোকান তৈরি করা হয়েছে, রাস্তা থেকে বোঝার উপায় নেই যে, পেছনে পুকুর আছে। চারপাশ দখল করে সেখানে হোটেল, রেস্তোরাঁ, স্বর্ণের দোকান, ফুচকা-চটপটির দোকানসহ নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। পূর্ব পাশে রয়েছে রিকশার কয়েকটি গ্যারেজ। একই সঙ্গে খাবারের হোটেল, বিভিন্ন স্টোরসহ রয়েছে বেশ কিছু দোকান। পশ্চিম পাশে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় বানানো হয়েছে। নতুন করে দক্ষিণ পাশে মাটি ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে ইটের দেয়াল। সেখানেও দোকান নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে। এদিকে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ২০০১ সালে পুকুরপাড়ে কোনো দোকান ছিল না। পুরো পুকুর পানিতে টইটুম্বুর ছিল। পরে ২০১৭ সালের দিকে ভরাট প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালে এসে, অর্থাৎ গত ছয় বছরে পুকুরের প্রায় অর্ধেক জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গেন্ডারিয়া ডিআইটি পুকুরটি একসময় স্থানীয় মানুষের গোসল, থালাবাসন ধোয়া, গরু-বাছুর ধোয়ানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে পুকুরটি যে আছে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। পুকুরের পাড় দখল করে দোকান তৈরি করা হলেও এখনো পুকুরের বড় অংশই দৃশ্যমান। ধীরে ধীরে ভিতরের অংশ দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা থেকেই চারপাশে মার্কেটের প্রাচীর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুকুর দখল নিশ্চিত করতে একাংশে দোতলা ভবনে কার্যালয় স্থাপন করেছেন স্থানীয় কাউন্সিলর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা বলেন, ‘এই পুকুরের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িত। ছোটবেলায় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কত সাঁতার কেটেছি! কিন্তু ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কবলে পড়ে পুকুরটি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন পুকুরের চারপাশ ছোট হয়ে আসছে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাহানা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজউক জায়গাটি অধিগ্রহণ করেছে সত্য, পরবর্তী সময়ে এটি আবার ব্যক্তিমালিকানায় চলে আসে। জাকির হোসেন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি পুকুরটির প্রকৃত মালিক। কাউন্সিলর কার্যালয়টি তার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়েছে।’ জাকির হোসেন বলেন, ‘পুকুরটির মালিক আমি। এটি নিয়ে রাজউকের সঙ্গে দীর্ঘদিন মামলা চলছিল। আদালত আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন।’ পুকুর ভরাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুকুরটি ভরাট না করে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে।’ তবে পরিবেশবাদী সংগঠনের দাবি, পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ডিআইটি প্লট পুকুরটি কতিপয় দুর্বৃত্ত ও দখলদার ভরাট করে দখলের পাঁয়তারা করছে, যা পুরান ঢাকাবাসীর জন্য খুবই লজ্জাজনক, উদ্বেগের ও ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গেন্ডারিয়ার জমি ডিআইটি অধিগ্রহণ করেছিল। তবে যে কাজের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল সে কাজে ব্যবহার না করায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে জমির প্রকৃত মালিক মামলা করায় সেটি ফেরত দেওয়া হয়। তবে আদালতের রায় যা-ই হোক কোনোভাবেই পুকুর বা জলাশয় ভরাট করা যাবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের আহ্বায়ক ও পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, ১৯৯২ সালে তৎকালীন ডিআইটি গেন্ডারিয়া এলাকার ১৩ দশমিক ৫৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে। সেখানে দুই একর পরিমাণ জায়গায় একটি পুকুর ছিল। গত ১০ বছরে এই পুকুরটির ৩০ শতাংশ ভরাট করেছে। এখনো ভরাট করছে। জলাধার আইন অনুযায়ী পুকুর ব্যক্তিমালিকানাধীন হলেও ভরাট করা যাবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গেন্ডারিয়ায় পুকুর ভরাট ও দখলের বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ জানা গেছে, গেন্ডারিয়া পুকুরটি খনন করা হয় ব্রিটিশ আমলে। তখন গেন্ডারিয়া থেকে যাত্রাবাড়ী, ধোলাইখাল, সায়েদাবাদ ও কুতুবখালী দিয়ে মানুষ নৌকায় যাতায়াত করত। কালের বিবর্তনে গেন্ডারিয়ার জলাধার বিলীন হয়ে যায়। ১৯৯২ সালে তৎকালীন ডিআইটি গেন্ডারিয়া এলাকার ১৩ দশমিক ৫৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে। সেখানে দুই একর পরিমাণ একটি পুকুর ছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর