শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিমান বানান চট্টগ্রাম নরসিংদীর দুই তরুণ

২ শতাধিক মডেল তৈরি করেছেন আশির

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

২ শতাধিক মডেল তৈরি করেছেন আশির

মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান। ওজন ১ কেজি ৮০০ গ্রাম। এটি ৪ কেজি ওজনের পদার্থ নিয়ে টানা ৩০ মিনিট আকাশে উড়তে পারবে। বিমানের গতিবেগ থাকবে ৪ কিলোমিটার। এটি কার্বন অর্বিক সিস্টেম। রাডার কন্ট্রোল সংযোগ। নিয়ন্ত্রণ করা হয় প্রোগ্রামেবল রিমোট কন্ট্রোলে। তুলনামূলক কম পাওয়ার দিয়েও চলতে পারবে এটি। 

যুদ্ধবিমানের এই মডেলটি তৈরি করেছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি ইউনিয়নের মাঝেরপাড়া গ্রামের আশির উদ্দিন। কেবল মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান নয়, তিনি তৈরি করেছেন বিভিন্ন প্রকারের ২ শতাধিক মডেলের বিমান। বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও ২৩ বছর বয়সী তরুণ আশির তৈরি করেছেন বিমানের মডেল। রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিমানগুলো বাড়ির আশপাশে খোলা জায়গায় ওড়ানোর পর  সফলও হয়েছেন। স্বপ্নবাজ তরুণ আশিরের এখন স্বপ্ন, যাত্রীবাহী বিমান তৈরির। নিজের তৈরি  বিমানে নিজেও যাত্রী হয়ে ঘুরবেন। একদিন বাংলাদেশেও তৈরি হবে যাত্রীবাহী বিমান। এ বিমান ঘুরবে দেশ-বিদেশ। লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ঘুরবে সারা বিশ্ব।  

শখ থেকেই বিমান তৈরি : ছোটবেলায় আকাশে বিমান উড়তে দেখতেন আশির। তখন থেকেই বিমানে চড়ার সাধ জাগত। তাই নিজের সাধ মেটাতে নিজেই বিমান বানানোর স্বপ্ন দেখা  শুরু করেন। বিমান উড়তে দেখে দেখে এক বছর পর্যন্ত গভীর চিন্তায় ছিলেন। ২০১৬ সালের কথা। প্রথমে খেলনার ছলে বিমান তৈরির চেষ্টা করেন। তারপর কম ওজনের ছোট আকারের বিমান বানিয়েই ফেলেন। চেষ্টা করেন রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে ওড়ানোর। প্রথম প্রথম কিছু বিমান ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। পরে আর নষ্ট হয়নি। ২০১৭ সালের দিকে প্রথমে বানিয়েছেন খেলনা বিমান, যেগুলো কিছুদূর উড়তে সক্ষম। এখন বানানো হয়েছে ২ শতাধিক বিমানের মডেল। 

আশির উদ্দিন বলেন, আকাশে বিমান উড়তে দেখে বিমানে চড়ার শখ তৈরি হয়। এক সময় চিন্তা করছি, নিজেই বিমান বানাব। সেই চিন্তা থেকে আস্তে আস্তে কাজ শুরু করি। পর্যায়ক্রমে এখন আমি বর্তমান অবস্থানে এসেছি। এখন আমার তৈরি ২ শতাধিক মডেলের বিমান আছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে অনেক বিমান নষ্ট হয়েছিল। এতে আমিও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতাম। তবে আমি হতাশ হইনি। প্রতিদিনই নতুন উদ্যম নিয়ে কাজ করেছি। সফলও হচ্ছি। 

১৫ বর্গফুটের ল্যাব থেকে আকাশ জয়ের স্বপ্ন : আশির কাজ করেন একটি ল্যাবে। সেটি বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকা পুঁইছড়ি ইউনিয়নে। ২০১৮ সালে এখানেই তিনি তৈরি করেছেন একটি ল্যাব। ল্যাবটির নাম ‘ইয়ার ক্র্যাপ্ট মেন্টেইনেন্স ল্যাব’। এটির আয়তন মাত্র ১৫ বর্গফুট। এখানে আছে- ওয়েডিং মেশিন, ড্রিল মেশিন, গ্ল্যান্ডার মেশিন, কাটার মেশিন, ডিজিটাল মাল্টি মেশিন, স্কেল মেশিনসহ নানা মেশিনারিজ। সেখানেই এসব উপকরণ দিয়ে চলে তার সব প্রকৌশলী বিদ্যার অনুশীলন। অজপাড়া গায়ে গড়ে তোলা এই ল্যাব থেকেই আকাশ জয়ের স্বপ্ন দেখেন আশির। এখানে তিনি পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে বিমান তৈরির কাজ করে থাকেন।  

কী কী আছে নির্মাণের তালিকায় : আশির তৈরি করেছেন নানা মডেলের ২ শতাধিক বিমান, ড্রোন ও ওয়াটার পাম্প। এর মধ্যে আছে, মিগ-২৯সহ প্রায় ৩০টি মডেলের যুদ্ধবিমান, দুই মডেলের যাত্রীবাহী বিমান, ড্রোন, অ্যাগ্রিকালচার ড্রোন, কার্গো বিমান, ফায়ার সার্ভিসের জরুরি মুহূর্তে সেবার উপযোগী বিমান, বাংলাদেশ বিমানের ড্রিমলাইনার বোয়িং-৮৭৮, চেসনা ও ইউএস বাংলার মডেলের বিমান, এমকিউ ড্রোন, এমআইডি ২৯, হেলিকপ্টার, এলউইন ইঞ্জিন, ওয়াটার পাম্প, এয়ার বোট ও ড্রিল মেসটন। এর মধ্যে ৩ কিলোগ্রাম ওজনের বোয়িং-৮৭৮ ড্রিমলাইনারটি ঘণ্টায় ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে সক্ষম। বিমান তৈরি করতে করতে তার চিন্তায় এলো ওয়াটার বোট নির্মাণের পরিকল্পনা। পরে বানিয়ে ফেললেন একটি। এটি জ্বালানি নয়, বাতাসের শক্তিতে চলে। তাছাড়া তিনি তৈরি করেছেন এগ্রিকালচার ড্রোন। এটি দুর্গম এলাকা কিংবা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ছবি তোলা, ফসলের খেতে কীটনাশক ছিটাতে কাজে আসবে। আশির বলেন, বাঁশখালীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে বিমানের মডেল তৈরির উপকরণগুলো সংগ্রহ করা অনেক কষ্টের। ঢাকায় থাকা আত্মীয়রা বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠান। আমার বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গুনাগরি বাজারে গিয়ে যন্ত্রাংশগুলো সংগ্রহ করতে হতো।

 

মানবিকের ছাত্র যখন বিমান তৈরিতে : আশির উদ্দিন ২০১৫ সালে বাঁশখালী পুঁইছড়ি ইজ্জতিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি এবং ২০১৭ সালে বাঁশখালী মাস্টার নজির আহমদ ডিগ্রি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজে চার বছর কোর্সের ইলেকট্রিক্যাল বিষয়ে পড়ছেন। তার বাবা একজন ব্যবসায়ী। তিন সন্তানের মধ্যে আশির সবার বড়। মানবিকের শিক্ষার্থী হয়েও আশির বিমানের মডেল তৈরিতে সক্ষম। আশির বলেন, একাডেমিক জ্ঞান নয়, আমি হাতেখড়ি ও বাস্তবজ্ঞান দিয়েই প্রথমে বিমান তৈরি শুরু করি। প্রথমে যে নকশা মাথায় আসে তা দিয়ে কাগজে একটা স্কেচ আঁকি। তারপর সেটা নিয়ে কাজ শুরু করি। স্কেচ অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে সংযোজনের উপযোগী করি। তারপর প্রয়োজনীয় ইলেকট্রিক্যাল কাজ শেষ করে আটা বা গাম দিয়ে লাগিয়ে তার একটা শেপ দেওয়ার চেষ্টা করি। চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রকৃত উপকরণ দিয়ে বিমান তৈরি করি। তবে এক্ষেত্রে আমার মনোবল এবং ইচ্ছাই ছিল বড় চালিকাশক্তি।

 

আশির যা বললেন : আশির উদ্দিন বলেন, ছোটবেলা থেকেই টেকনিক্যাল কাজ নিয়ে চিন্তা করতাম। আকাশে বিমান উড়তে দেখে মনে স্বপ্ন বুনতাম। বিমান বানানোর চিন্তা করতাম। পরে নিজের পড়ালেখার খরচের টাকা দিয়ে নানা ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য নিয়ে আকাশে ওড়া নানা ধরনের বিমান বানানোর স্বপ্ন দেখি। তৈরি করি, নষ্ট হয়। এভাবে শতাধিক বিমান ক্রাশ করে। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুরা যখন মাঠে খেলত, আমি তখন ছোট্ট ল্যাবে যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ করতাম। অবসরের পুরো সময়টা ল্যাবেই দিয়েছি। ল্যাবে সময় দিয়ে ব্যর্থ হইনি। এক সময় নানা সমস্যা থাকলেও এখন প্রায় কেটে উঠেছি। এখন ফেসবুক ও ইউটিউবে আমার অ্যাকাউন্ট আছে। ব্লগিং করি। 

তিনি বলেন, ২২ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি মডেল তৈরিতে আমার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এরই মধ্যে আমার তৈরি মডেল অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ক্রয় করেছে। আমি মনে করি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমি সফল হব, বিমান তৈরির জন্য সমৃদ্ধ ল্যাব স্থাপন করতে পারব। দেশেই তৈরি করা যাবে যাত্রীবাহী বিমান। 

আশির বলেন, বিমান বাহিনী থেকে আমাকে এরোমেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স করার জন্য বলা হয়েছে। আগামী মাস থেকে আমি এ কোর্সে যোগ দেব। একই সঙ্গে সেখানে ড্রোন ও বিমানের ডিজাইন তৈরির চাকরিও করব।

তিনি বলেন, আগামীতে ৭০ কেজি ওজন বহন করতে পারে এমন বিমান বানানোর ইচ্ছা আমার। এ জন্য ৬ কেজি ওজনের মোটর দিয়ে তৈরি করা হবে বিমান। এটি তৈরি করতে প্রয়োজন টাকার। 

আশির বলেন, আমার স্বপ্ন, যাত্রীবাহী বিমান বানানো। সে বিমানে আমি নিজেও যাত্রী হয়ে ঘুরতে চাই। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। তবে এখন পর্যন্ত কারও সহযোগিতা নিইনি।

সর্বশেষ খবর