দেশের কারাগারগুলোতে অস্থিরতা থামেনি। বন্দি পলায়ন থেকে শুরু করে বন্দি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেই চলছে। গতকালও চট্টগ্রাম ও জামালপুর কারাগারে বন্দি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। জামালপুর কারাগারে বিদ্রোহের ঘটনায় ছয় বন্দির মৃত্যু ঘটেছে এবং জেলারসহ ১৯ জন আহত হয়েছেন। এ অবস্থায় দেশের ৬৮টি কারাগারে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু কারাগারে সেনা মোতায়েনও করা হয়। গত ১০ দিনে গাজীপুর, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ, ভোলা, কুষ্টিয়া, কাশিমপুর, শেরপুরসহ অন্তত ১৪টি কারাগারে বিদ্রোহ ও বন্দি পালানোর ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, জামালপুরে জেলা কারাগারের জেলারসহ কারারক্ষীদের জিম্মি করে কারা ফটক ভেঙে বন্দিরা পালানোর চেষ্টা করায় ব্যাপক গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে এ বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এ সময় ছয় কারাবন্দির মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন জেলারসহ অন্তত ১৯ জন। নিহতরা হলেন, আরমান, রায়হান, শ্যামল, ফজলে রাব্বি বাবু, জসিম ও রাহাত। তাদের সবার বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলায়।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক আন্দোলনের পর গ্রেফতারকৃত অনেককে সরকার মুক্তি দিয়েছে। এরই সূত্রধরে বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে ৩০ থেকে ৪০ জন বন্দি তাদের মুক্তির দাবিতে বিদ্রোহ শুরু করেন। এ নিয়ে বন্দিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি শুরু করেন। এর মধ্যে বিদ্রোহী গ্রুপের বন্দিরা কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জেলারের কাছে এসে কারা ফটকের চাবি চান। তখন জেলার আবু ফাত্তাহ কয়েদিদের চাবি দিতে না চাইলে তাকে জিম্মি করে কারাগারের ভিতরের ফটক ভেঙে বন্দিরা বের হওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারারক্ষীরা গুলি এবং টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেন। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে পাশর্^বর্তী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ শহরজুুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টা থেমে থেমে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। এক পর্যায়ে কারাগারের অভ্যন্তরে জেলারের অফিস কক্ষ, বিভিন্ন ওয়ার্ড এবং কারা হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ করেন বন্দিরা। আগুনের ধোঁয়ায় পুরো কারাগার এলাকা ছেয়ে যায়। বিদ্রোহী বন্দিরা বাকি কারারক্ষীদের ওপরও হামলা করে তাদের জিম্মি করে ফেলেন। কারাগারে হট্টগোল এবং গুলির শব্দ পেয়ে পাশেই অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকা সেনাবাহিনী এগিয়ে এসে কারাগারের চারপাশ ঘিরে ফেলে। এ সময় কারাগারের ভিতর থেকে ‘আমাদের বাঁচান’ বলে আর্তনাদের শব্দ পাওয়া যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে কারাগারের দেয়ালের ওপর দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ সময় মাইকিং করে কয়েদিদের শান্ত থাকা ও পালিয়ে না যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এদিকে বিদ্রোহী বন্দিদের হাতে দুই ঘণ্টা বন্দি থাকার পর বেশ কয়েকজন বন্দির সহযোগিতায় জেলার আবু ফাত্তাহ আহত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। পরে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সন্ধ্যার পর কারাগারে বিদ্রোহী বন্দিদের কাছে জিম্মি থাকা তিন নারীসহ ১৩ কারারক্ষীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে রুকনুজ্জামান (৫০), সাদেক আলী (৪৫) ও জাহিদুল ইসলাম (৪১) নামে তিন কারারক্ষী বন্দিদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন এবং একজন গুলিবিদ্ধ থাকায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জামালপুর কারাগারের জেলার আবু ফাত্তাহ জানান, কারাবন্দিদের মধ্যে যারা বিদ্রোহে অংশ নেয়নি তাদের জিম্মি করে ও নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় পাঁচ বন্দি ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন বন্দির মৃত্যু হয়। বিদ্রোহের প্রায় ১০ ঘণ্টা পর মধ্য রাতে জামালপুর জেলা কারাগারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে কর্তৃপক্ষ। বিদ্রোহের ঘটনায় জেলারসহ ১৩ কারারক্ষী ও পাঁচজন বন্দি আহত হয়, আহতদের বেশ কয়েকজন কারারক্ষীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং বাকিদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে আহতদের মধ্যে তিন কারারক্ষীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে একজনকে এরই মধ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়াও নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। জেলার আরও বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়া বন্দিদের মৃত্যুর কারণ এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না এবং ময়নাতদন্ত ছাড়া পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরও সম্ভব নয়। এ কারাগারে ৬৬৯ জন কারাবন্দি ছিল, তবে কোনো রাজনৈতিক বা জঙ্গি আসামি নেই। আর কয়েদিদের মধ্যে কেউ পালাতেও পারেনি।
চট্টগ্রাম কারাগারে বিদ্রোহ : চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বিদ্রোহ করেন কয়েদিরা। পরে সেনাবাহিনী ও কারারক্ষীদের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। গতকাল দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।
জেলার মো. মাসুদ রহমান বলেন, জুমার নামাজের পর কিছু কয়েদি বিদ্রোহ করে। এ সময় কারাগারে পাগলা ঘণ্টা বাজানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি করা হয়। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এরপর থেকে কারাগারের ভিতর সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। বিদ্রোহের ঘটনায় কতজন আহত, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে দায়িত্বরত কয়েকজন কারারক্ষী বলেন, দুপুরে নামাজ পড়া শেষে হঠাৎ কারাগারের একাধিক ভবনে কয়েদিরা বিদ্রোহ শুরু করেন। তারা কারাগার ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি করা হয়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়।
লালদিঘীর পার এলাকার বাসিন্দারা জানান, জুমার নামাজের পর কেন্দ্রীয় কারাগারে ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। বাইরে থেকেও কিছু মানুষ কারাগারের প্রধান ফটক ভাঙার চেষ্টা করেন। এ সময় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রসঙ্গত, এর আগে ৫ আগস্ট বিকালে কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলার চেষ্টা করা হয়। পুলিশ ও কারারক্ষীরা হামলা প্রতিরোধ করেন। বর্তমানে কারাগারে প্রায় ৪ হাজারের বেশি বন্দি রয়েছেন।