আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের দাপ্তরিক কাজে দেখা দেয় স্থবিরতা। সেই স্থবিরতা কাটাতে এবং প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিভিন্ন সচিব পদসহ বড় ধরনের রদবদল আনা হয়। বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বও দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও দাপ্তরিক কাজ চলছে ধীরগতিতে। যদিও নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।
গত কয়েকদিন সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা গেছে, অনেক মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের তেমন কাজই নেই। অফিসে সময় করে আসছেন, সময় শেষে বের হচ্ছেন। অনেক ডেস্কে কাজ একেবারেই কম। এর কারণ হিসেবে একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। একজন উপসচিব বলেন, সিনিয়রদের থেকে কাজ নিচে গড়াবে। ওপরের দিকে কাজ নেই, আমার টেবিলেও কাজ নেই। একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, অনেক মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা সচিব নেই। রুটিন দায়িত্বে অনেকেই। আবার যারা সচিব হয়েছেন বা হচ্ছেন তারাও নানা ধরনের হিসাব করে কাজ করছেন ফলে গতি কম।
বিভিন্ন কর্মকর্তার রুমে দেখা গেছে, কাজের চাপ কম থাকায় কেউ আড্ডায় ব্যস্ত। বেশির ভাগ কর্মকর্তা নিজ রুমেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। কারও সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক আলোচনায়ও যেতে চান না। কেউ কেউ দেশের সার্বিক বিষয় খোঁজ রাখছেন টেলিভিশন পত্রিকা পড়ে। ইতোমধ্যেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান অফিস সময়ে কক্ষে থাকাসহ পাঁচ নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রশাসনিক কাজের ধীরগতি নিয়ে সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেহেতু বর্তমান সরকার থেকে অনৈতিক চাপ নেই, আবার কর্মকর্তারা পদে আছেন, বেতন নিচ্ছেন ফলে এতদিন নানা অজুহাত দেখালেও মূলত কাজের সময় এখনই। তবে যেখানে সচিব নেই সেখানে দ্রুত সচিব দেওয়া উচিত। যারা রুটিন দায়িত্বে আছেন তাদেরও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রথম দিকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে এজন্য সরকার হয়তো একটু সতর্কভাবে হাঁটছে।
এই সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের কাজে কোনো সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা যাবে না। সিভিল সার্ভিসে অনেক সমস্যার মধ্যে আড্ডার সংস্কৃতি একটা। যেহেতু সরকারের সুযোগ নিচ্ছি, বেতন নিচ্ছি সেহেতু ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হবে। পদে থেকেও যদি কেউ সন্তোষজনক দায়িত্ব সম্পাদন না করে তাহলে সরকারকে ভিন্ন কিছু ভাবতে হবে ওই লোক নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যেক মন্ত্রণালয় যে শাখা থেকে বদলি পদায়ন করা হয় এর বাইরের শাখাগুলোতে একেবারেই কাজের চাপ কম। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা যায়, দাবি-দাওয়া নিয়ে কম বেশি লোকজন ভিড় করেন সিনিয়র সচিবের দপ্তরে আর পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে। এর বাইরে সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ আর বিধি অনুবিভাগে কিছুটা কাজ থাকলেও একেবারে কাজের চাপ কম অন্য অনুবিভাগগুলোতে। শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, কোনো কাজ নেই। তাই আমাদের স্যারকে বাড়তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবেরও দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ পদোন্নতির সময় এখান থেকেই সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট নেওয়ার হয়। বিভিন্ন বিভাগীয় মামলার শৃঙ্খলা দেখা হয়। ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগেও কাজের চাপ কম জানা গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রিসভা ও রিপোর্ট অনুবিভাগের কাজ কম যেহেতু মন্ত্রিসভাই নেই। জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ কিছুটা এখন গতি পাচ্ছে। কেননা মাঠ প্রশাসনে রদবদল হয়েছে। তোশাখানা ইউনিট, আইন অনুবিভাগে কাজের চাপ নেই একেবারেই। তোশাখানা ইউনিট নিয়ে এক কর্মকর্তা জানান, সেখানে যেহেতু জাদুঘর কার্যক্রম আছে। জাদুঘরে ইতিহাস সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনেক ছবি আছে। আপাতত সেসব ডেকে রাখা হয়েছে। তবে এসব ছবি একেবারে বের করা হবে কিনা বা কোন প্রক্রিয়ায় হবে সে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। আইন শাখায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কালেভদ্রে অধ্যাদেশ নিয়ে কাজ হলেও চাপ কম বলে জানা গেছে। মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শুদ্ধাচার, বাৎসরিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সেটি এখনো পাওয়া যায়নি। এতে অনেক বিষয় এমনিতেই আটকে আছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নতুন সচিব যোগ দিয়েছেন।
ফলে কাজে গতি ফিরবে প্রত্যাশা করছেন বিভাগের কর্মকর্তারা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি অত্যন্ত ধীর গতি দেখা গেছে। গত কয়েকদিন সচিবালয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ, স্থানীয় সরকার, কৃষি, ভূমি মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা গেছে যেখানে কর্মকর্তাদের বদলি পদায়নসংশ্লিষ্ট সেই বিভাগের বাইরে অন্য উইংগুলো তুলনামূলক কাজের চাপ কম। সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু রদবদল করলেই প্রশাসনে গতি আসবে এই ধারণা যারা করে তারা মিথ্যার স্বর্গে বিশ্বাস করে। যাদের হাতে এখন রাষ্ট্র চালানোর দায়িত্ব তাদেরকে নিয়মিত মনিটরিং এবং নেতৃত্ব দিতে হবে। এই নেতৃত্বের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তারা অধীনস্ত মানুষদের মনিটরিং এবং উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন না। রাজনৈতিক দল হোক, স্বৈরাচার হোক, সেনাবাহিনী হোক, সরকার যে চালাবে কাজের ক্ষেত্রে গতি আনার দায়িত্ব তাদেরই। আগে মন্ত্রীরা চালাতেন এখন উপদেষ্টারা চালান। আইনের শাসন যেটা বলি সেটা করতে হবে।
এদিকে, সরকারের তিন মন্ত্রণালয় ও পাঁচ বিভাগে বর্তমানে কোনো সচিবই নেই। সচিব না থাকা মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোতে অতিরিক্ত সচিবরা দায়িত্ব চালিয়ে নিচ্ছেন। এতে তাদেরও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। পরে সচিব যোগ দিলে বর্তমান সিদ্ধান্ত বাতিল হবে কি না সেটি ভেবে কোনো রকম দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
মাঠ প্রশাসনে দুটি বিভাগে কমিশনার নেই এবং আটটি জেলায় ডিসি নেই। সচিব, কমিশনার ও ডিসির মতো গুরুত্বপূর্ণ এসব শূন্য পদ পূরণের কোনো জোর উদ্যোগ নেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। উপযুক্ত কর্মকর্তা বাছাই ও পদায়নের কাজে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোথাও কাউকে দিলেও আবার পরক্ষণেই আদেশ বাতিল করার ঘটনাও ঘটছে।
জানা গেছে, অনেক মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি আনতে সংশ্লিষ্ট সচিবরা দক্ষতা দেখাতে পারছেন না। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেরও একই দশা। অনেক মন্ত্রণালয়ে সচিবরা দায়িত্ব নিলেও মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বা উইংগুলোতে রদবদল করতে গিয়ে কয়েকবার ভাবছেন। কি হয়, না হয় এসব নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ধীরগতি রয়েছে কাজের ক্ষেত্রেও। একজন সচিব নাম প্রকাশ না করে বলেন, কাজের চাপ কম বলব না তবে অনেক কাজ এমনিতেই কমে গেছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন, গত সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কাজ কমে গেছে। তবে এই সরকারের যে লক্ষ্য আছে তা কিন্তু চলমান। ওই সচিব আরও বলেন, আসলে অনেক সচিব হিসাব করে হয়তো এগোচ্ছেন। ভুল কাজ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ে না করাই ভালো সেটিও একটি বিষয় হতে পারে। ৬ নম্বর ভবনের এক যুগ্মসচিব বলেন, কার ওএসডি হয় কার বদলি হয় এসব নিয়ে ভাবনায় সবাই। কোনো মতে দিন পাড় করার ঘটনা চলছে।