জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) হচ্ছেটা কী? প্রতিষ্ঠানটিতে ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত পদার্থবিজ্ঞান থেকে পাস করা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা আবদুল মুমিন মোছাব্বির পেয়েছেন প্রাথমিকের শিশু, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব। আমার বই (ফাইভ প্লাস) এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের বিশেষজ্ঞের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থনীতি থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ গাজী মো. নাজমুল হোসেনকে।
শুধু মুমিন মোছাব্বির বা নাজমুল হোসেন নন, এনসিটিবিতে এখন অনেকেই এমন বই সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন করতে বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পেয়েছেন যাঁদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক কোনো ধারণাই নেই। এভাবেই বছরের পর বছর এক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ দিয়ে আরেক বিষয়ের পাঠ্যবইয়ের সম্পাদনা, বানান ও তথ্যগত ভুলত্রুটি সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো একাডেমিক পাঠ না থাকলেও তাঁরাই করছেন ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের এসব পাঠ্যবই সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন কার্যক্রম। ফলে গত কয়েক বছরের মতো আগামী শিক্ষাবর্ষেও শিক্ষার্থীদের কাছে ভুলে ভরা বই যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর খোদ এনসিটিবি থেকেই তাঁদের এমন দায়িত্ব বণ্টন করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উত্তীর্ণ সোহানুর রহমান বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন খ্রিস্টধর্ম বইয়ের, মৃত্তিকাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করা রুমা বেগম বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করছেন শিশুদের অঙ্কন শেখানো আর লিখতে শেখানো বইয়ের। বাণিজ্যে (হিসাববিজ্ঞান) উত্তীর্ণ মফিজুর রহমান বিশেষজ্ঞ হয়ে আছেন গণিত বইয়ের। একইভাবে শিক্ষা ও গবেষণায় অধ্যয়ন করে গণিত বই সংশোধন-পরিমার্জনের দায়িত্ব পেয়েছেন আহসানুল আরেফিন চৌধুরী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উত্তীর্ণ আবদুল্লাহ আল যোবায়ের দায়িত্ব পেয়েছেন তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ের বইয়ের। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকের সম্পাদনা, বানান, ভাষা, তথ্যগত ভুলত্রুটি সংশোধন, হালনাগাদকরণ, ছবি-গ্রাফের যথার্থতা নিরূপণ ও উন্নয়ন, সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জনসহ যাবতীয় কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব দেয় এ কর্মকর্তাদের। এনসিটিবিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকসহ বিভিন্ন দপ্তরের একই অবস্থা বলে জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছেন, উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে এমন ব্যক্তিকে দিয়ে মনোবিজ্ঞান বইয়ের কাজ করানো হচ্ছে যার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে তো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। তাই যোগ্য লোক খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যদি তাঁদের ইচ্ছেমতো এনসিটিবিতে পদায়ন করেন তবে অভিজ্ঞরা দায়িত্ব পাবেন না এটাই স্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে শিক্ষা খাত শেষ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।’ এনসিটিবির ২০১২ সালের কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির এ চিফ কনসালট্যান্ট বলেন, ‘এনসিটিবিতে কোন যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার কর্মকর্তা প্রয়োজন তা এনসিটিবি থেকে লিস্ট করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতাম আমরা।’ এ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব না দিলে বই সংশোধন না হয়ে ভুলে ভরা হবে এটাই স্বাভাবিক।’
এনসিটিবি সূত্র জানান, বই সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জনের গুরুদায়িত্ব সম্পাদনা বিভাগের। কিন্তু সম্প্রতি এ বিভাগে এমন কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয় থেকে পদায়ন দেওয়া হয়েছে যাদের সম্পাদনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই নেই। এ কর্মকর্তাদের দিয়েই দায়সারাভাবে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে এনসিটিবি। ফলে ভুল থাকার শঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে অনেক সংস্কার হচ্ছে, তাহলে এনসিটিবি এভাবে চলবে কেন? এখানে সংস্কার নেই কেন? এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এক বিষয়ের কর্মকর্তাকে অন্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব দেওয়ার মানে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাত্তাই দিচ্ছি না আমরা। ছাত্রছাত্রীদের এমন অবহেলা করা ঠিক হচ্ছে না।’ এনসিটিবিতে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে কর্মকর্তা পদায়ন দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির এক শীর্ষ কর্তা জানান, এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পাওয়ার পেছনে দায়ী হলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। কারণ তাঁরা বিভিন্ন তদবির আমলে নিয়ে একের পর একজনকে এনসিটিবিতে বদলি করেন। কিন্তু এনসিটিবিতে কোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, বা কোন যোগ্যতার কর্মকর্তা প্রয়োজন তা আমলারা কখনোই জানতে চান না। দেখা গেছে, কাছের লোককে রাজধানীতে পদায়নের জন্য কোথাও শূন্যপদ না পেলে বিষয় বিবেচনা না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এনসিটিবিতে পদায়ন দেন। এ পরিস্থিতির কারণে এনসিটিবিকে বাধ্য হয়ে এক বিষয়ে উত্তীর্ণকে অন্য বিষয়ের বই সংশোধনের কাজ দিতে হচ্ছে। তাঁরা আরও জানান, এনসিটিবি একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। এখানে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধারণা রয়েছে এমন কর্মকর্তাকেই পদায়ন দেওয়া উচিত।
এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কর্মকর্তাদের এনসিটিবি পদায়ন করে না, পদায়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। খুব শিগগিরই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে যেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ পাওয়া যায়।’
তথ্যমতে জুলাই অভ্যুত্থানের পর অল্প কিছু পদে রদবদল করা হয়েছে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের বই ও কারিকুলাম প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা এনসিটিবিতে। কিন্তু স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও নওফেলের হাতে পদায়নকৃত ও তাঁদের অনুগত অনেক কর্মকর্তাই এখনো আছেন বহাল তবিয়তে। তাঁদের মাধ্যমেই চলছে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই মুদ্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর আওয়ামী লীগ আমলে অনুগত কর্মকর্তাদের পদায়নের কারণে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে এখনো দীপু মনির এলাকা চাঁদপুর-কুমিল্লার কর্মকর্তার সংখ্যাধিক্য রয়েছে বলে জানা গেছে।