রপ্তানি খাতের পর এবার রেমিট্যান্স আয়ের ওপর পড়তে যাচ্ছে ট্যাক্সের খড়গ। প্রবাসী আয়ের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৫ শতাংশ ট্যাক্স কার্যকর হলে এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেমিট্যান্সে করারোপ হলে বৈধপথে প্রবাসী আয় পাঠানো কমে যাবে; হুন্ডির ফাঁদে পড়বে প্রবাসীরা। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে করে ডলারের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, রেমিট্যান্সের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের করারোপের প্রক্রিয়াটি এমন সময় নেওয়া হয়েছে, যখন আমাদের বৈদেশিক খাত চাপের মুখে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি আরও ঝুঁকিতে পড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই অধ্যাপক ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, এ ধরনের করারোপের কারণে দেশে বসবাসরত প্রবাসী পরিবারগুলোর প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় অর্থ পাঠানোর কারণে অনিয়ন্ত্রিত পন্থায় হুন্ডির ব্যবহার বেড়ে যাবে। বিদেশ থেকে অর্জিত প্রবাসী আয়ের প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা তৈরি হবে। এতে করে প্রাতিষ্ঠানিক পন্থায় প্রবাসী আয় পাঠানোর বিষয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স দেশে প্রবাসী আয়ের সবচে বড় উৎস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ২১ হাজার ৭৮৪ মিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় অর্জিত হয়েছে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে সর্বাধিক ৩ হাজার ৯৪০ মিলিয়ন ডলার। ৫ শতাংশ হারে কর কার্যকর হলে এখান থেকে প্রায় ১৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কেটে রাখত যুক্তরাষ্ট্র। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষের দিকে রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে চলে গিয়েছিল, যা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একটি দেশের রিজার্ভে ৩ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমপরিমাণ রিজার্ভকে নিরাপদ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আমদানি ব্যয় কমায় ও বড় বড় প্রকল্পের কেনাকাটা বন্ধ থাকায় রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ২৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি উঠেছে। তবে এখনো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ঝুঁকিতে রয়েছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। রেমিট্যান্সে করারোপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিল আইনে পরিণত হলে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক অফিসের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বৈশ্বিক বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিগেটেড (সমন্বিত) পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে প্রেরণ করে। এরা বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে রেমিট্যান্স কিনে নেয়। পরে এই আয় একত্র করে নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্য দেশে পাঠায়। আর এ কারণেই বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস্য হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুক্তরাষ্ট্র যদি রেমিট্যান্স আয়ে করারোপ করে তবে প্রবাসীরা বৈধপথে অর্থ পাঠাবেন না। এটি যেমন বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে চাপ তৈরি করবে, তেমনি সরবরাহ কমে গিয়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।