সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ের বারেক টিলার সামনের ঘাটে ১ আগস্ট ভেড়ানো ছিল বিশাল সব হাউসবোট। ঘুরতে আসা পর্যটকরা রাতে এখানেই বিশ্রাম নেবেন। শান্ত পরিবেশে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ ছিল না। হাউসবোটগুলোর জেনারেটরের বিকট শব্দে অনেকেই কানে হাত দিয়ে রাখেন। বেড়াতে আসা পর্যটকরাও সাউন্ডবক্সে জোরে জোরে গান শুনছিলেন। সব মিলিয়ে যে শব্দদূষণ তৈরি হয়, তা অনেক পর্যটকই সহ্য করতে পারছিলেন না। হাওড়ে থাকা পাখি বা অন্য প্রাণীর জন্যও যা ছিল ভীতিকর।
স্থানীয় পরিবেশ সংগঠন হাওড় এরিয়া আপলিফটমেন্ট সোসাইটির (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাওড়ের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে। এটি হচ্ছে আইনের প্রয়োগ না হওয়া এবং ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে। এ হাওড়কে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তা মেনে চললেই হাওড় ভালো থাকত। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওড়ে তিন বছরের জন্য লকডাউন দেওয়া উচিত। বন্ধ থাকবে প্রবেশাধিকার। এ সময়ের মধ্যে মাছ ও পাখি ফিরে আসবে। এরপর প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার বিধান মেনে ধীরে ধীরে মানুষের প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে। আগে পরিবেশ, তারপর পর্যটন। টাঙ্গুয়ার হাওড়কে ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের জানুয়ারিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রামসার কনভেনশনের আওতায় দেশের ‘রামসার সাইট’ হিসেবে এই হাওরকে ঘোষণা করা হয়। কিছুদিন আগে হাওড়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য ১২টি নির্দেশনা জারি করে জেলা প্রশাসন। হাওড়ের জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি, পরিবেশ ও সৌন্দর্য রক্ষায় পর্যটকদের সচেতন করতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। বাস্তবে কেউ-ই এ নির্দেশনা মানছেন না। সরেজমিন দেখা যায়, হাওড় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ২০০০-এর ওপর বিশাল সব হাউসবোট। ইঞ্জিনচালিত এসব বোটে ৫০ থেকে ১০০-এর বেশি লোক বহন করার ব্যবস্থা রয়েছে। বোটে জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতিরিক্ত শব্দদূষণ হচ্ছে। পর্যটকরা চিপসহ খাবারের প্লাস্টিক প্যাকেট হাউসবোটের ময়লার ঝুড়িতে না ফেলে পানিতে ফেলছেন। অনেকে গোসল করে সাবান-শ্যাম্পু ও কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানি ফেলছেন। নষ্ট হচ্ছে হাওড়ের পানি। কয়েকজন মাঝি বলেন, আগে যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যেত এখন তা মিলছে না। আগে ওয়াচ টাওয়ারের আশপাশে পাখির ওড়াওড়িও ভালো ছিল।
এখন অনেক কম। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওড়ের পানিতে মিলেছে উচ্চমাত্রার ভারী ধাতু। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির একদল গবেষকের গবেষণায় বিষয়টি উঠে আসে।
হাওড়ের ওপরে থাকা পানিতে ছয় ধরনের ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে। এগুলো হচ্ছে-নিকোল, ক্রোমিয়াম, সিসা, জিংক, তামা ও ম্যাঙ্গানিজ। ১২টি স্থানের মধ্যে বারেক টিলার পানিতে সবচেয়ে বেশি দূষিত ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০১৫-এর সবশেষ রেড ডাটা বুকের তথ্য অনুযায়ী- টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ১৩৪ প্রজাতির মাছ, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১৯ প্রজাতির দেশি ও বিদেশি পরিযায়ী পাখি, ২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১০৪ প্রজাতির উদ্ভিদ থাকলেও বর্তমানে এগুলোর বেশির ভাগই বিলুপ্তির পথে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০ বছরে এ হাওড়ে দেশি ও পরিযায়ী পাখি কমেছে ৭৭ শতাংশ।