ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। প্রতিবন্ধীদের সহায়তার নামে সূচনা ফাউন্ডেশন খুলে এই টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। একই সঙ্গে ৯৩০ কোটি টাকার বেশি সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে সংস্থাটি।
দুদকের অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, অর্থ আত্মসাতের কাজে পুতুলকে সহায়তা করেছেন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, ইউনাইটেড গ্রুপ এবং মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ৩৫ জন ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে অর্থ প্রদান ও কর ফাঁকির মাধ্যমে প্রায় ৪৪৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং প্রায় ৯৩১ কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১১ ট্রাস্টি, সালমান এফ রহমান ও আজিজ খানসহ ৮ ব্যবসায়ী এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যানসহ ১৬ জন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। অনুমোদন হওয়া এজাহারে আসামি হিসেবে নাম রয়েছে সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও চেয়ারপারসন প্রফেসর ডা. মাজহারুল মান্নান, ট্রাস্টি ও সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন, ট্রাস্টি সায়ফুল্লাহ আবদুল্লা সোলেনখী, সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রেজারার শামসুজ্জামান, ট্রাস্টি জ্যান বারী রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রাণ গোপাল দত্ত, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য প্রফেসর রুহুল হক, শিরিন জামান মুনির, এম এস মেহরাজ জাহান ও সদস্য ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া হামিদ রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান ইন্তেকাবুল হামিদ, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ওরফে সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান, সাবেক এমপি এ কে এম রহমাতুল্লাহ, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দীন হাসান রশিদ, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ও বিল ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান এনায়েতুর রহমান। অন্যদিকে এনবিআরের আসামিরা হলেন- সাবেক মুখ্যসচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, এনবিআরের সাবেক সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) মীর মুস্তাক আলী, সাবেক সদস্য (ইন্টারন্যাশনাল ট্যাক্সেস) চৌধুরী আমির হোসেন, সাবেক সদস্য (কর নীতি) পারভেজ ইকবাল, সাবেক সদস্য (শুল্ক নীতি) ফরিদ উদ্দিন, সাবেক সদস্য (শুল্ক নিরীক্ষা) ফিরোজ শাহ আলম, সাবেক সদস্য (মূসক নীতি) ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন, সাবেক সদস্য (লিগ্যাল) ডা. মাহবুবুর রহমান, সাবেক সদস্য (কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবা) লোকমান চৌধুরী, সাবেক সদস্য (মূসক) রেজাউল হাসান, সাবেক সদস্য (কর জরিপ ও পরিদর্শন) জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, সাবেক সদস্য (কর প্রশাসন) আবদুর রাজ্জাক, সাবেক সদস্য (শুল্ক রপ্তানি ও বন্ড) এ এফ এম শাহরিয়ার মোল্লা ওরফে আবু ফয়সাল মো. শাহরিয়ার মোল্লা, সাবেক সদস্য (শুল্ক ও ভ্যাট শাখা) সুলতান মো. ইকবাল, সদস্য (বোর্ড প্রশাসন) তন্দ্রা সিকদার এবং সাবেক সদস্য (কর আপিল ও অব্যাহতি) কালীপদ হালদার।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, সূচনা ফাউন্ডেশন নামীয় নামসর্বস্ব ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রদান করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে আসামিরা আয়কর আইনের ক্ষমতার অপব্যবহার করে কর মওকুফ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেন। যার মাধ্যমে তারা ৪৪৭ কোটি ৯৫ লাখ ৩০ হাজার ১৯৩ টাকা আত্মসাৎ করেন। অন্যদিকে সূচনা ফাউন্ডেশন ২০১৫-২০১৬ করবর্ষ থেকে ২০২৪-২০২৫ পর্যন্ত মোট ৯৯ লাখ ৪ হাজার ৫৩১ টাকা আয়কর প্রদান না করে প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। এ প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া কর জমার রেকর্ডপত্র তৈরি করে অডিট প্রতিবেদনে ‘আয়কর খরচ’ হিসেবে প্রদর্শন করে। এর মাধ্যমে ওই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বা বিনিময়ে অবৈধ পারিতোষিক গ্রহণ করে তা দলীয় বা ব্যক্তিগত ব্যবহারে আত্মসাৎ করার পূর্বপরিকল্পনায় সূচনা ফাউন্ডেশন নামের প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১৪টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। ওই ব্যাংক হিসাবে জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে মোট ৯৩০ কোটি ৯৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৯ টাকার লেনদেন করে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন আসামিরা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের প্রতিষ্ঠিত সূচনা ফাউন্ডেশনের খোঁজে ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডে অবস্থিত সুধাসদনে অভিযান চালায় দুদক। এই বাড়িটিসহ সূচনা ফাউন্ডেশন বেশ কয়েকটি ঠিকানা ব্যবহার করলেও কোনোটিতে অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি তারা। তবে দৃশ্যমান অস্তিত্ব না পেলেও সাত মাসের ব্যবধানে পুতুলের এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ লুটপাট, কর ফাঁকিসহ বিস্তর দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক।