‘বন্দি করে রাখা অবস্থায় ডিবি জানিয়েছিল, আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যার নির্দেশ ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের। তারা (ডিবি) দয়া করে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া নিজের জবানবন্দিতে এ কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ভবনে আগুন দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর দায় চাপানো হয়েছে।’ জবানবন্দিতে ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে নিজের চোখের সামনে পুলিশের গুলিতে দুই আন্দোলনকারী নিহত ও আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার বর্ণনা দেন তিনি। চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল প্রসিকিউশনের ১৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি দেন তিনি। তাঁর এ জবানবন্দি শেষ না হওয়ায় পুনরায় জবানবন্দি গ্রহণের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার দিন রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পুলিশের সাবেক আট সদস্য এ মামলার আসামি। তাদের মধ্যে চারজন পলাতক। আশুলিয়া থানার সামনে ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনার মামলায় আরও এক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৫ অক্টোবর দিন ঠিক করেছেন ট্রাইব্যুনাল-২। জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘গত বছর ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে ৫ জুন শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়।’ তিনি বলেন, ‘পরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট মর্মে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদানের পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। সেদিন তাদের হামলায় শতাধিক ছাত্রছাত্রী গুরুতর রক্তাক্ত আহত হয়। আহত ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানেও ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে।’ আসিফ আরও বলেন, ‘২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমি, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। সেখানে আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের দিয়ে আমরা সুস্থ আছি মর্মে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুনুর রশীদ (ডিবি হারুন) এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারে আমাদের ওপর চাপ ও হুমকি প্রদান করতে থাকেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য চাপ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। বারবার বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই আমাদের তুলে আনা হয়েছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে মর্মে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। তারা (ডিবি) দয়া করে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।’ ডিবিতে জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিওবার্তা রেকর্ড করে গণমাধ্যমে প্রচার করার কথা জানিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘ডিবি অফিসে বন্দি অবস্থায় আমরা আমরণ অনশন শুরু করি। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে থাকার পর আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ আগস্ট আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া প্রয়োজন : প্রথম দিনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীমকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সাক্ষ্যে ট্রাইব্যুনারের কাছে কী কী বিষয় তুলে ধরেছেন, তা গণমাধ্যমকে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, আমরা মনে করি দল হিসেবে তাদের বিচার হওয়া প্রয়োজন।’
আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর মামলায় আরও একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ : ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আরও এক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রসিকিউশনের ১৪ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন গত বছর ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের ভ্যানে পুড়িয়ে দেওয়া ওমর ফারুকের বাবা চাঁন মিয়া। পরে তাঁকে জেরা শেষ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।