বয়স ২১-২৫ বছর। পুরুষ। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট। নিরোগ শরীর। সুঠাম গড়ন। কালো চুল। চোখের মণি কালো। বুদ্ধিমান ও মেধাবী। মাপকাঠি মোটামুটি এমনটাই। ইন্টারনেট আর খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও ছাপা হয় এই মর্মে। তবে পাত্র চাই কলামে নয়। কারণ প্রয়োজনটা বিবাহবিষয়ক নয় একেবারেই। তবে প্রজনন বিষয়ে তো বটেই। শুক্রাণু দাতা খুঁজতে এমনই বিজ্ঞাপন দেয় বিভিন্ন স্পার্ম ব্যাঙ্ক। দান বটে, কিন্তু তাও পারিশ্রমিক দেওয়া হয় এবং তা আইনি পথেই। কলকাতার বিভিন্ন ফার্টিলিটি সেন্টার এবং স্পার্ম ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষরা জানাচ্ছেন, কৃত্রিম প্রজননের সূত্রে ক্রমেই বেড়ে চলেছে শুক্রাণু দান বা ডোনেটেড স্পার্মের চাহিদা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে শুক্রাণু দাতার সংখ্যাও। শুক্রাণু দান করে মাস গেলে কয়েক হাজার টাকার 'পকেট মানি' সহজেই হাতে এসে যায় বলে, কলকাতাতেও 'ভিকি ডোনার'দের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়তই
প্রশ্ন কেন বাড়ছে শুক্রানু দাতার সংখ্যা? জিনোমের ফার্টিলিটি স্পেশ্যালিস্ট শিউলি মুখোপাধ্যায়ের মতে, 'সহজ অঙ্ক। প্রয়োজন বাড়ছে তাই। আজকাল বন্ধ্যাত্ব নিবারণের চিকিৎসা প্রযুক্তি ঢের এগিয়েছে। সচেতনতা বাড়ায় বন্ধ্যাত্বের চিকিত্সা করাতেও অনেক বেশি দম্পতি আসছেন আমাদের ক্লিনিকে। ফলে দানের শুক্রাণুর চাহিদা বাড়ছে। তা ছাড়া স্বামী বন্ধ্যা নন (থ্যালাসেমিক হাজবেন্ড) কিংবা অন্য কোনো রোগের (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, ক্যান্সার) কারণে বা কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসার (কেমোথেরাপি) কারণে স্বামীর বন্ধ্যাত্বের আশঙ্কা রয়েছে, এমন ক্ষেত্রেও ডোনেটেড স্পার্ম ব্যবহারের রেওয়াজ তৈরি হয়েছে।'
কিন্তু শুক্রাণু দাতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মাপকাঠির কেন এত বায়নাক্কা? শেক্সপিয়র সরণীর ওই প্রতিষ্ঠানেরই বন্ধ্যাত্বরোগ বিশেষজ্ঞ ঐন্দ্রী সান্যালের বলেন, 'আজকালকার স্মার্ট মহিলাদের সিংহভাগই আমাদের অনুরোধ করেন, এমন দাতার শুক্রাণু তার জন্য ব্যবহার করতে যার সামাজিক ও অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। আর আমাদের সমাজে এখনো যেহেতু কালো চুল ও মণির কদর কমেনি, তাই সেই ঐতিহ্যই পছন্দ করেন অধিকাংশ সন্তানকামী মহিলা। এমনকি তার স্বামীর ব্লাড গ্রুপের সঙ্গে মিলিয়েই ব্যবস্থা করা হয় ডোনেটেড শুক্রাণুর, যাতে আগত সন্তানের ব্লাড গ্রুপ তার মা-বাবার ব্লাডগ্রুপের ম্যাচিং মেনেই হয়।'
তার সহকর্মী কৌশিকী রায় সরকার কিংবা নোভা-ইভি ফার্টিলিটি সেন্টারের মেডিক্যাল ডিরেক্টর রোহিত ঘুটঘুটিয়া জানান, নারী স্বাধীনতার হাত ধরে আজকাল অনেক মহিলাই সিঙ্গল মাদার হতে ইচ্ছাপ্রকাশ করছেন। তাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাও দানের শুক্রাণুর চাহিদা বাড়াতে সঙ্গত করছে ইদানীং। বার্থের কর্ণধার গৌতম খাস্তগীরও বলেন, 'এই চাহিদা আগামী দিনে আরো বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।'
তবে সংখ্যার নিরিখে দিল্লি-মুম্বাই-ঔরঙ্গাবাদ-বেঙ্গালোর-চেন্নাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জায়গায় এখনো আসেনি কলকাতা। মহানগরের বিভিন্ন ফার্টিলিটি সেন্টারকে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভিন রাজ্যের স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে চাহিদামতো শুক্রাণুর নমুনা সরবরাহ করে আসছেন গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, কলকাতায় মোটে চারটি স্পার্ম ব্যাঙ্ক রয়েছে-ভবানীপুরের কেয়ার আইভিএফ ও বার্থ, বেকবাগানে ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রিপ্রোডাকশন (আইএইচআর) এবং বেহালায় সার্জি সেন্টার। অথচ মুম্বাইয়ে রয়েছে অন্তত ১৬টি স্পার্ম ব্যাঙ্ক। দিল্লিতে কমপক্ষে আটটি, ঔরঙ্গাবাদের মতো ছোটো শহরেও অন্তত ছ’টি স্পার্ম ব্যাঙ্ক রয়েছে। 'তবে গত ক’ বছরে ডোনেটেড স্পার্মের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে কলকাতায়ও। শহরটিতে পাঁচ বছর আগেও মাসে ৩০০টির মতো শুক্রাণুর নমুনা আসত ভিন রাজ্য থেকে। আর এখন সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৮০০-এ,' জানান গৌতমবাবু।
কলকাতার বিভিন্ন ফার্টিলিটি সেন্টারের কর্তারা জানান, 'এ শহরের প্রায় সব বড় ফার্টিলিটি ক্লিনিকেই শুক্রাণু সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তাকে ঠিক ব্যাঙ্কিং বলা যায় না। কারণ তাদের ভাঁড়ারে রাখা শুক্রাণু মূলত তাদের নিজস্ব রোগিণীদের জন্যই। অন্য কোনো ফার্টিলিটি ক্লিনিকের সন্তানকামী মহিলাকে তারা কেউ-ই শুক্রাণু সরবরাহ করে না।' তবে হাতের কাছে দাতা পাওয়া গেলে (বা বিজ্ঞাপন মারফত আগত) তার দান করা শুক্রাণু মজুত করে ব্যবহার করে প্রায় সব ফার্টিলিটি সেন্টারই। সে জন্য দান পিছু এক থেকে আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার রেওয়াজ আছে কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা মেনে। যদিও খুব ভালো দাতার জন্য হাজার দশেক টাকার দাম দিতেও কুণ্ঠিত হয় না অনেক ফার্টিলিটি সেন্টার। ফলে হাতখরচের খাতায় 'বোনাস' পেতে আগ্রহী যুবকদের অনেকেই আজকাল স্পার্ম ব্যাঙ্কে 'সার্ভিস' দিতে অপছন্দ করেন না। সূত্র : এই সময়
বিডি-প্রতিদিন/১১ জুলাই ২০১৫/শরীফ