১৪ আগস্ট, ২০১৬ ১২:১০

অভিশাপের ভয়ে যে শহরে বাস করেন না কেউই!

অনলাইন ডেস্ক

অভিশাপের ভয়ে যে শহরে বাস করেন না কেউই!

আটটি ছোট ছোট শহর নিয়ে গড়ে উঠেছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। তার মাঝেই পঞ্চম শহরটি একেবারে পরিত্যক্ত। কারণ, ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ এ এক পীরের অভিশাপ। যার দরগায় মানত করলে মনোকামনা কখনই বিফল হয় না। এরকম শক্তিশালী সন্তের অভিশাপকে তাই লঘু করে দেখার চেষ্টা করেন না কোন ভারতবাসীই। তিনি নিজামউদ্দিন আউলিয়া।

ইতিহাস নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে চিনে এসেছে করুণাবতার বলেই! তার দরগায় প্রার্থনা জানিয়েই পুত্রের মুখ দেখেছিলেন যোধাবাঈ আর আকবর। লোকবিশ্বাস, নশ্বর শরীর ত্যাগ করলেও নিজামউদ্দিন কোথাও যাননি। ভক্তদের মনোকামনা পূরণ করার জন্য তিনি এখনও পৃথিবীতেই রয়েছেন। সেই জন্যই তার দরগা এত জাগ্রত!

ইতিহাসের পথে চোখ রাখলে প্রথমেই দেখা যাবে ধুলো! পথের ধুলো! সেই ধুলো আরও বেশি করে উড়ছে হাতি-ঘোড়া-মানুষের পায়ে পায়ে। তৈরি হচ্ছে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সাধের নগরী তুঘলকাবাদ। বলাই বাহুল্য, ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই শহরের মধ্যে সবার প্রথমে তৈরি হয়েছিল সুলতানের প্রাসাদ। ইবন বতুতার ভ্রমণকাহিনি থেকে জানা যায় যে সেই প্রাসাদের ঐশ্বর্য ছিল চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো! এতটাই মসৃণ ছিল সেই পাথরের দেওয়াল, এতটাই মূল্যবান রত্নখচিত ছিল তা যখন সূর্যের আলো এসে পড়ত প্রাসাদের ভিতরের দেওয়ালে, তখন আলোর ছটায় চোখ ঝলসে যেত। 

ধীরে ধীরে সুলতান আরও সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে চান তার নগরী। আদেশ দেন, নগরীর প্রতিটি নারী-পুরুষকে শ্রমদান করতে হবে তার জন্য। অন্যদিকে, ঠিক একই সময়ে নগরীর মানুষের পানির কষ্ট মেটানোর জন্য একটা বড় কূপ খননের কাজ শুরু করেন পীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া। তিনিও এই কাজে চান নগরীর বাসিন্দাদের সাহায্য।

আর, ঠিক এই জায়গা থেকে শুরু হয়ে যায় ধর্ম বনাম রাজশক্তির সংঘাত। তুঘলক স্বাভাবিক ভাবেই চেয়েছিলেন, তার নগর নির্মাণের কাজেই সময় দিক প্রজারা। তাই আদেশ জারি করেন তিনি-যত দিন না নির্মাণের কাজ পুরোটা শেষ হচ্ছে, কোন নগরবাসীই অন্য কোন কাজ হাতে নিতে পারবে না। আদেশ জারি করে তুঘলক চলে যান বাংলার যুদ্ধ জয় করতে।

আউলিয়ার কূপ খননের কাজ কিন্তু তা বলে থেমে থাকে না। প্রজারা রাজাকে ভয় পেয়ে দিনের বেলা তার আদেশ পালন করত। আর পীরকে ভালবেসে, শ্রদ্ধায় রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে তারা হাত দিত কূপ খননের কাজে।

কিন্তু সেই খবর চাপা রইল না। বাংলায় বসেই খবর পেলেন তুঘলক, তার নগর নির্মাণের কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। কেননা, দিনে-রাতে পরিশ্রম করে প্রজারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। রেগে গিয়ে তাই ফরমান জারি করলেন সুলতান- যারা পীরকে কূপ খননের কাজে সাহায্য করবেন, তাদের মৃত্যু সুনিশ্চিত!

যা হওয়ার, তাই হল! এই ফরমান জারি হওয়ার পর আর কোন প্রজা পীরকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল না। আত্মাভিমানেও ঘা লাগল তখন আউলিয়ার এবং পরিণামে ক্ষুদ্ধ পীরের অভিশাপ নেমে এল তুঘলকাবাদ নগরীর বুকে- এই নগরী জনমানবহীন হয়ে যাবে! একমাত্র রাখাল ছাড়া আর কারও পায়ের চিহ্ন এখানে পড়বে না।

কথাটা জানতে পেরে বেশ অপমানিত বোধ করলেন তুঘলক। এও জানতে পারলেন, আউলিয়ার অভিশাপের পরে তুঘলকাবাদে থাকতে চাইছেন না কোন প্রজাই! শুধুই তাঁরা অপেক্ষা করছেন রাজার ফিরে আসার জন্য! সব শুনে তুঘলকাবাদে ফেরার চিন্তা করলেন সুলতান। মনোভাবটা অনেকটা এই- 'নগরীতে ফিরেই আউলিয়াকে দেখে নেব!' সেই খবর পেয়ে পীর শুধু হেসে বলেছিলেন, 'দিল্লি এখনও অনেকটা দূর!'

তুঘলকের কিন্তু সাধের নগরীতে ফেরা হয়নি। বাংলা বিজয়কে সম্মান জানাতে তার অগ্রজ পুত্র শহরের বাইরে এক আমবাগানে উৎসবের আয়োজন করেন। সেখানে সুলতানের বসার জন্য তৈরি হয়েছিল এক কাঠের মণ্ডপ। মণ্ডপে ছোট ছেলেকে নিয়ে বসে সকলের অভিনন্দন গ্রহণ করছিলেন তুঘলক। এমন সময়ে আচমকাই একটি হাতি দিগবিদিক হারিয়ে ছুটে আসে সেখানে। তছনছ করে দেয় সেই কাঠের মণ্ডপ। পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় তুঘলক আর তাঁর ছোট ছেলের!

ঘটনার পর আর তুঘলকাবাদে থাকতে চাননি গিয়াসউদ্দিনের প্রথম সন্তান। তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেন আদিলাবাদে এবং আউলিয়ার অভিশাপই সত্যি হয়। জনমানবহীন হয়ে পড়ে তুঘলকাবাদ। সত্যি হয় অভিশাপের পরের অংশটুকুও। আজও কেউ সেখানে পা রাখেন না। আগাছায় আর ঘাসে ঢাকা তুঘলকাবাদ বর্তমানে রাখালদের চারণভূমি। গরু-ছাগল চরে বেড়ায় সেখানে। এমনকী পর্যটকরাও তুঘলকাবাদ দেখতে চাইলে বেশ সমস্যায় পড়েন। তুঘলকাবাদের দিকে কোন বাস যায় না। যেতে চায় না কোন অটো রিকশা বা ট্যাক্সিও! কারণটা কিন্তু পীরের অভিশাপ! শুধুমাত্র অভিশাপের জন্যই এখনও জনমানবহীন হয়ে রয়েছে তুঘলকাবাদ।

সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন

বিডি প্রতিদিন/১৪ আগস্ট ২০১৬/হিমেল-১৪

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর