‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। চট্টগ্রামে পাকিস্তানি শাসকচক্র যখন বাংলার মানুষের অধিকার প্রত্যাখ্যান করে সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল গণহত্যার মাধ্যমে জনগণকে দমন ও নির্যাতন করতে, তখনই বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর হয়ে চট্টগ্রাম শহরের রাজনীতিসচেতন প্রগতিশীল সংস্কৃতজন ও বেতারকর্মী মিলে চালু করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের প্রচারমাধ্যম— এ বেতার কেন্দ্র, যা মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিল অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে। প্রথম কদিন কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে অনেকেই এসেছেন, চলে গেছেন আর আসেননি। শেষ পর্যন্ত যারা পাকিস্তানিদের শ্যেনদৃষ্টি উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের এই মনস্তাত্ত্বিক প্রচারাভিযান চালু করেছিলেন জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার মানুষ, সংস্কৃতিসেবী, শিক্ষক-লেখক অনেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
কালুরঘাট বেতার প্রক্ষেপণ কেন্দ্র, যেখান থেকে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। গণহত্যা চালানোর জন্য হানাদার বাহিনী হিসেবে পাকিস্তানিরা যে হামলা চালিয়েছিল সাধারণ মানুষের ওপর, সেই পরিস্থিতিতে মেজর জিয়ার ঘোষণা পাঠ দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানিদের বিমান হামলায় কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন বিধ্বস্ত হয়ে গেলে সম্প্রচার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। তখন এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি ওখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বগাফাই জঙ্গলে, আগরতলার কাছে। সীমান্ত অতিক্রমের জন্য ট্রাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মেজর জিয়া।
এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রচারকাজ চালানোর জন্য শক্তিশালী বেতারের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন এবং ভারত সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। সেই সুবাদে আমরা ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়ামওয়ে শক্তিসম্পন্ন একটা ট্রান্সমিটার পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কোথায় ছিল, তা আমরা জানতাম না নিরাপত্তার কারণে। ভারতের নিরাপত্তা বিভাগ এ ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ছিল, যেন এই গোপন বেতার সম্প্রচারের বিষয়টি কেউ না জানতে পারে। আমি আজও বলতে পারব না, কোথায় ছিল এই ট্রান্সমিটারটি। আমরা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়ির ওপর তলায় একটি স্টুডিও প্রথম স্থাপন করি এবং প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায় রচিত হয়েছিল। পাঠক, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বিপ্লবী শব্দটা বাদ পড়েছে, খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন কেন এমন হলো। মেজর জিয়াকে যখন রাজি করিয়ে পটিয়া থেকে কালুরঘাট নিয়ে আসেন বেলাল মোহাম্মদ, তারপর মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা যে পাঠ করবেন, তাতে কী লিখবেন, তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘আমাদের মহান নেতা’ উল্লেখ করে তার নামেই ঘোষণা দেন। তবে ঘোষণা পাঠ করতে যাওয়ার আগে মেজর জিয়া ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শব্দটি বাদ না দিলে তিনি পড়বেন না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাই হোক, ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিয়ে ঝঃধঃরড়হ পধষষ দেওয়া শুরু হলো। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র হয়ে গেল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়া পর্যন্ত ওই নামেই পরিচিত ছিল বিদ্রোহী বেতার হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষে এরই নাম হলো ‘বাংলাদেশ বেতার’।
কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে বিএসএফের ঘাঁটির পাশে একটি দোতলা বাড়িতে চালু করা হয়েছিল। এ বাড়িতে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থাকতেন। তারা অন্যত্র সরে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গেলেন থিয়েটার রোডে, খন্দকার মোশতাক আহমদ গেলেন পার্ক সার্কাসে ‘বাংলাদেশ মিশন’ নামের পুরনো পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনারের বাড়িতে। হোসেন আলী সাহেব ছিলেন ডেপুটি হাইকমিশনার, যিনি পরে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাংলাদেশে যোগ দেন। বালিগঞ্জের ওই বাড়িতেই রেকর্ডিং হতো একটি কামরাকে স্টুডিও বানিয়ে। যথার্থ স্টুডিও ছিল না। ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে রেকর্ডিং মেশিনটি চালানো হতো। বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ থাকত। আর রেকর্ডিংয়ের সময় পাঠক কিংবা কথক অথবা গায়ক-শিল্পীদের ঘেমে চুপসে একসার হতে হতো। আজও প্রথম দিনের রেকর্ডিংয়ের কথা মনে পড়ে। সে কি অদ্ভুত দৃশ্য, সৈয়দ হাসান ইমাম ‘সালেহ আহমেদ’ ছদ্মনাম নিয়ে খবর পড়ছিলেন। প্রচণ্ড গরমের মে মাস। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরম। খবর পড়তে পড়তে ঘেমে যাচ্ছেন, তাই জামা খুলে রেকর্ডিং করছেন। আবার বন্ধ করে ফ্যান ছেড়ে খানিক ঘাম শুকিয়ে আবার মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে বসছেন। এমনি করেই প্রোগ্রাম রেকর্ডিং শেষ করে স্পুলটি বা স্পুলগুলো একটি পোর্টফোলিও হ্যান্ডব্যাগে চুকিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে তুলে দিতাম। আর একটি জিপ তাকে নিয়ে ছুটত নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। এমনি করে আমরা রেকর্ডিং করে দিতাম, চলে যেত শহর কলকাতা থেকে ৪০-৫০ মাইল দূরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি। এই বেতার কার্যক্রম চালু হয়েছিল ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছানো বেতার প্রযোজকদের উদ্যোগে। তখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের সেই প্রত্যুত্পন্নমতিত্বের পরিচয় দেওয়া ‘বিদ্রোহী’ সহযোগীরা কলকাতা পৌঁছাননি। ঢাকা বেতারের প্রযোজক আশফাকুর রহমান খানের নেতৃত্বে তাহের সুলতানের সহযোগিতায় রেকর্ডিং চালু করা হয়েছিল। সিএইচ শিকদার, শহীদুল ইসলাম, পরে আশরাফুল আলম কেন্দ্রে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আরও অনেকে এসে পৌঁছতে লাগলেন, শিল্পী-মন্ত্রী, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী, সুরকার, গীতিকারসহ নানা কিসিমের সবাই জমায়েত হলাম বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডে। ২৫ মে শুরু হবে ট্রান্সমিশন। নিউজ লেখার ও পড়ার কেউ নেই। নেই কোনো সরঞ্জামও। এমনি অবস্থায় পটুয়া কামরুল হাসান বললেন, শান্তিনিকেতনি কায়দায় বসে পড় মাটিতে। কাগজ নেই। পত্রিকার পাশে যে সাদা অংশটুকু থাকে, তাতেই লিখে বুলেটিন তৈরি করলাম এবং পড়লামও নিজেই। সৈয়দ হাসান ইমাম সালেহ আহমদ নামে খবর পাঠ করতেন। প্রথমদিকে তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশি ছিল না, পরে সে সব জোগাড় হলো।
প্রথমদিকে দিনে দুটো অধিবেশন সকালে ক্ষণস্থায়ী এবং সন্ধ্যায় দীর্ঘস্থায়ী হতো। প্রথমে বাংলা এবং একদিন পরেই ইংরেজিতে বুলেটিন তৈরি করে দিতাম। কিন্তু কালক্রমে চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর, আলী যাকের, পারভীন হোসেন, নাসরিন শিমু ইংরেজি বিভাগে এলেন। বাংলা বিভাগে ম. মামুন, মৃণালকৃষ্ণ রায়, সুব্রত বড়ুয়াসহ উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সমর দাস, অজিত রায়, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, প্রণোদিত বড়ুয়া, আপেল মাহমুদ, মলয় কুমার গাঙ্গুলী, রথীন্দ্রনাথ রায় উল্লেখযোগ্য। তারা গানের কিছু টেপ ঢাকা ও চট্টগ্রাম বেতার থেকে নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো ছিল পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলনে সৃষ্ট এবং গণনাট্য সংঘের গণসংগীত, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের স্বদেশী গান। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক গান রচনা ছিল খুবই জরুরি। তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেকেই গান রচনা করেছেন। কলকাতার বন্ধু গোবিন্দ হালদার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছিলেন অনেক গান এবং দুটো এক্সারসাইজ বুক ভর্তি সেই গানগুলো দিয়েছিলেন আমার হাতে, বেতারের ব্যবহারের জন্য। তার সে গানের মধ্যে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ আর ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল, পরে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না’ গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
পরে অবশ্য প্রতিদিন তিনটি— সকালে, দুপুরে এবং রাতে অনুষ্ঠান অধিবেশন শুরু হয়েছিল। আর বাংলা ও ইংরেজি বাদেও উর্দু ভাষায় সংবাদ ও নানা প্রোগ্রাম প্রচার করা হতো। উর্দু প্রোগ্রাম চালাতেন জাহিদ সিদ্দিকী। সহযোগী ছিলেন কজন— পারভীন হোসেন, এস রহমান। আর এই সার্ভিস করা হয়েছিল অবাঙালি ভারতবাসী এবং পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের জানাতে, কেন বাংলার মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হলো। ইংরেজি সার্ভিস ছিল বিশ্ববাসীর জন্য। আর বাংলা মূল সার্ভিসটি ছিল বাংলার সব মানুষের জন্য। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এসব স্থানের বাংলাভাষী বিশেষ করে অবরুদ্ধ বাংলার জিম্মি মানুষগুলোকে শত্রু মোকাবিলার সাহস ও প্রেরণা জোগানোই ছিল প্রধান কাজ। সেই সঙ্গে মুক্তিফৌজের রণাঙ্গনের সাথীদেরও চাঙ্গা রাখা, কিছুটা প্রেরণাদায়ক দেওয়া ছিল অন্যতম। আমাদের সম্প্রচার থাকত ‘জয় বাংলা’ গানটি (অধিবেশনের সূচনাসংগীত), কোরআন তেলাওয়াত, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা উদ্ধৃত ‘বজ্রকণ্ঠ’, রণাঙ্গনের সৈনিকদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান, সংবাদ, চরমপত্র, জল্লাদের দরবার, নানা ধরনের কথিকা, জীবন্তিকা, গান, কবিতা, নাটক, নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা ইত্যাদি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল লড়াইয়ের মনস্তাত্ত্বিক ফ্রন্ট। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র কিংবা কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র বা ডা. শফীর বাসায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই এই বিপ্লবী বেতারের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্বে যে ১০ জন সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা হলেন— বেলাল মোহাম্মদ, সৈয়দ আবদুস শাকের, মুস্তাফা আনোয়ার, আজিজুর রহমান, রাশেদুল হাসান, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কাজী হাবিবুর রহমান মণি, শরফুজ্জামান এবং রেজাউল করিম চৌধুরী। কালুরঘাটে পাকিস্তানি বোমা বিস্ফোরণ হলে এরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরা চলে যান। বগাফাই জঙ্গলে ও আগরতলায় সম্প্রচার অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে আগরতলায় অবস্থানরত দুই-চারজন বেতারে এসেছিলেন। কিন্তু প্রস্তুতি এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম শহরেই যারা এই বেতার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে সৈয়দ আনোয়ার আলী, মঞ্জিলা আনোয়ার, ঘোষক হোসনে আরা, নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ, নাট্যজন মাহবুব হাসান, সংগঠক মাহমুদ হাসান, বেতার কর্মকর্তা আবদুল কাহ্হার চৌধুরী, বার্তা সম্পাদক সুলতান আলী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, পত্রিকার সম্পাদক কবি আবদুস সালামের নামও উল্লেখযোগ্য।
আবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠার পর ৫০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারের যে ব্যবস্থা হয়েছিল, তার সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন টাঙ্গাইল থেকে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী এমএনএ আবদুল মান্নান। তিনি প্রবাসী সরকারের তথ্য ও প্রচার বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু বিশেষভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেখাশোনার কাজে প্রতিদিন তিনি বেতারে আসতেন এবং নিয়মিতভাবে তার সঙ্গী ছিলেন জিল্লুর রহমান (সাবেক রাষ্ট্রপতি) ও দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ। এরা দুজনও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। এরা আমাদের সুখ-দুঃখ যেমন আলোচনা করতেন, তেমনি অনুষ্ঠান নিয়েও কথা বলতেন এবং পরামর্শ দিতেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারের জনপ্রিয়তা ছিল অবরুদ্ধ বাংলায়, রণাঙ্গনে, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে বাংলাকে দখল করে রেখেছিল, তখনকার সেই বাংলার আপামর জনসাধারণ সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক, সহায়কশক্তি। কিন্তু তাদের দিনরাত কাটত শঙ্কায়, সন্ত্রস্ত অবস্থায়— কখন না জানি হামলা হয় তাদের ওপর, কখনবা মৃত্যুকে মোকাবিলা করতে হয়। তবু তারা উন্মুখ হয়ে থাকতেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ ও অনুষ্ঠান শুনতে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল আমাদের একমাত্র মাধ্যম যার সাহায্য-সহযোগিতায় আমরা যেমন দেশে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জনসাধারণ্যে আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছি, তেমনি মানুষকে জানাতে পেরেছি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সাহসী যুদ্ধকাহিনী, শত্রুর পরাজয় এবং লড়াকু মুক্তিফৌজ ও অকুতোভয় বাঙালির বিজয়ের আনন্দ সংবাদ। এই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ বেতার ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সব শিল্পী, সাংবাদিক, কলাকুশলীর লড়াইয়ের ময়দান। নেহাতই নিজস্ব। পরিচালনা ও সংগঠনে কেবলই ছিলেন লড়াকু বাংলার অকুতোভয় সাহসী ও অতুলনীয় মেধাসম্পন্ন কর্মবীরদের যুদ্ধক্ষেত্র।
লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক