পরকীয়া আর ডাকাতির মাল ভাগাভাগির জেরে রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে একই পরিবারের চারজনকে খুন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, নিহত সাজু অপরাধ চক্রের সদস্য ছিলেন। তার নিজের দলের হাতেই তিনি খুন হয়েছেন। তাকে খুন করার পর সাক্ষী যাতে না থাকে সে জন্য স্ত্রী রঞ্জি এবং দুই শিশুসন্তান ইমরান ও সানজিদাকে হত্যা করা হয়।
রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন সেন্টারে শুক্রবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।
পুলিশ সুপার বলেন, 'এ খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত দুইজনসহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতাররা হলেন- মো. জাকারিয়া হোসেন ওরফে জনি (২৬), মো. সুমন ওরফে সিএনজি সুমন (৩০), আ. মজিদ (২৪), মো. রফিক (৩৮), সাহিদা বেগম (৩৬), মুক্তা বেগম (৩০) ও রানী বেগম (১৮)। এদের মধ্যে মো. জনি ও ‘সিএনজি সুমন’ খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। নাসির, আফসানা ও সুমন ঢালী ওরফে ডাকাত সুমন খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকলেও পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। খুনিদের আত্মগোপন ও পালাতে সাহায্য করায় বাকি আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে।'
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে এসপি হাবিবুর রহমান বলেন, 'ডাকাত সুমনের মোটরসাইকেল চুরি, নবাবগঞ্জের চুরাইন বাজারে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির লুণ্ঠিত মালামাল বাটোয়ারা এবং ডাকাত সুমন ও জনির স্ত্রীর সঙ্গে সাজুর অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে সাজুকে সপরিবারে খুন করা হয়। সাজুকে খুনের পর হত্যাকারীরা ইয়াবা সেবন করে বাকিদের খুন করে।'
তিনি বলেন, '২২ সেপ্টেম্বর ডাকাত সুমন মোবাইল ফোনে সাজুর স্ত্রী রঞ্জির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। সন্ধ্যার পর জনি, সিএনজি সুমন, নাসির, আফসানা ও ডাকাত সুমন কদমপুরে সাজুর বাসায় একত্রিত হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাজুর স্ত্রী রঞ্জি, ছেলে ইমরান ও মেয়ে সানজিদাকে পাশের ঘরে বন্দী করে। এরপর সাজুর হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করে। রাত আড়াইটার দিকে রঞ্জিকে ওই ঘর থেকে বের করে পাশের ঘরে নিয়ে হাত-পা বেধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর ইমরান ও সানজিদাকেও একইভাবে হত্যা করা হয়।'
এসপি হাবিবুর রহমান বলেন, 'সাজুর ভাই বশির উদ্দিনের মামলার (মামলা নম্বর- ৩৬, তাং- ২৫/০৯/১৪, ধারা- ৩০২/২০১/৩৪ দণ্ডবিধি) ভিত্তিতে বুধবার প্রথমে আব্দুল্লাহপুর থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইয়াবা সরবরাহকারী মজিদ ও হাসনাবাদ থেকে রফিককে গ্রেফতার করা হয়। পরে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে জনি ও সাহিদাকে এবং ভোর সাড়ে ৪টার দিকে গাজীপুরের জয়দেবপুর ভাওয়াল এলাকা থেকে সিএনজি সুমন ও রানীকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তাকে গ্রেফতার করা হয় যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে।'
তিনি বলেন, 'আমরা যখন ঘটনাস্থল ফ্ল্যাটটি পরিদর্শন করি তখন সেখানে স্বাভাবিক পরিবার বসবাসের কোনো লক্ষণ পাইনি। তা দেখেই আমাদের সন্দেহ হয় এখানে কোনো অপরাধী চক্রের আনাগোনা রয়েছে। তদন্তে আমরা জানতে পারি ভাড়া নেওয়ার সময় অন্য একজন লোক ও মহিলা এসেছিলেন। এ বাড়িটি কেন ভাড়া নেওয়া হয়েছিল তা এখনও জানা যায়নি। তারা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার পর একটি বাতিও লাগায়নি। মোমবাতি ও চার্জার লাইট দিয়ে তারা আলোর প্রয়োজন মেটাতো। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও তথ্য বের হয়ে আসবে। আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে শুধু একটা কথাই বলছিল যে, গাদ্দারি করার জন্য সাজুকে তারা খুন করেছে।'
এদিকে গ্রেফতার হওয়া জনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, 'জীবনে কতটি ডাকাতি করেছি তার সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না। সাজু ছিল দলের অন্যতম সদস্য। ঘটনার দিন রাতে ডাকাত সুমন আমাকে মোবাইলে ওই বাসায় ডাকে। বাসায় গিয়ে দেখি সিএনজি সুমন, নাসির ও আফসানা অবস্থান করছে। সেখানে সুমন আমাকে জিজ্ঞাসা করে খাওন (ইয়াবা ট্যাবলেট) আনছোস নাকি? খাওন নাই বললে সুমন ধমক দেয়। পরে মজিদকে মোবাইলে ইয়াবা আনতে বলে। সেখানে সুমনের স্ত্রীর সঙ্গে সাজুর অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সুমন ও জনি সাজুকে মারধোর শুরু করে এবং উলঙ্গ করে পুরষাঙ্গে রশি দিয়ে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়। পরে তারা সবাই মিলে সাজুকে সপরিবারে শ্বাসরোধের মাধ্যমে হত্যা করে।'
এ সময় জনি বলেন, 'দুই মাস আগে গাজীপুর এলাকায় একটি ডাকাতি করা হয়। সেখানে আমরা চারজন অংশ নিয়েছিলাম। ডাকাতির টাকার বেশির ভাগই নিজে রেখে দেয় সাজু। এর কয়েকদিন পর শুনতে পাই সুমনের প্রথম স্ত্রী লাকীর সঙ্গে সাজুর পরকিয়ার কথা। সুমন বিষয়টি জানার পর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। রফিকও জানতে পারে তার স্ত্রীর সঙ্গে সাজুর অবৈধ মেলামেশার খবর। চার বছর ধরে মেলামেশার ফলে তাকে চিনতে পেরেছি। সে একটা ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক। আগে সে ট্রাক চালাতো। সাজু এক বাসায় দুই চার মাসের বেশি থাকে না। তাকে অনেকদিন ধরে মারার পরিকল্পনা ছিল আমার। কিন্তু কাউকে সঙ্গী পাচ্ছিলাম না। কিছুদিন আগে নবাবগঞ্জের চুরাইন বাজারে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করার পর তাকে মেরে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। কিলিং মিশনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডাকাত নাসির, সুমন-২ ও তার স্ত্রী আফসানা। সেখানেই সিদ্ধান্ত ফাইনাল করি।'
বিডি-প্রতিদিন/২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪/ আহমেদ