স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হ্রাস পাওয়ায় দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্থ হতে পারে বলে মনে করছে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'উন্নয়ন অন্বেষণ'। প্রতিষ্ঠানটির মাসিক 'বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রতিবেদন'- এর বাজেট পরবর্তী সংখ্যায় এ আশঙ্কা করা হয়েছে।
'উন্নয়ন অন্বেষণ' দেখায় যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয়ের পরিমান অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক কম। এদিকে মোট বরাদ্দের বড় অংশ অনুন্নয়ন ব্যয় মেটাতে ব্যবহৃত হয় ফলে উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য বরাদ্দের পরিমান তুলনামূলক ভাবে অপর্যাপ্ত। তদুপরি লক্ষ্য করা যায় যে, সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত খাত দুটির জন্য বরাদ্দকৃত উন্নয়ন ব্যয় অর্থাৎ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বাস্তবায়নও অসন্তোষজনক।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করে যা সামাজিক খাতের উন্নয়ন তথা টেকসই মানবসম্পদ উন্নয়নের ধারাকে ব্যহত করতে পারে।
চ্যালেঞ্জগুলো হল-
অঞ্চল ও লিঙ্গ ভিত্তিক কাঠামোগত আর্থসামাজিক অসমতা, সার্বজনীন সেবা প্রদানে সক্ষমতার অভাব, এবং সেবা গ্রহনের ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিদ্যমান বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ যথা অঞ্চল ও লিঙ্গ ভিত্তিক কাঠামোগত আর্থসামাজিক অসমতা, সার্বজনীন সেবা প্রদানে সক্ষমতার অভাব, এবং সেবা গ্রহনের ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা - কে আমলে নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট নীতি কাঠামোর পুনঃ নিরীক্ষণের তাগিদ দিয়েছে যা নীতি সমুহের কার্যকারিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজে অধিকার ভিত্তিক সামাজিক পরিসেবা প্রদান নিশ্চিত করবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলে যে একদিকে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে মোট সরকারি ব্যয়ের পরিমানের দিক থেকে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে, ফলে সামাজিক সেবা খাতে পর্যাপ্ত সরকারি বিনিয়োগের অভাবে দেশে সামাজিক সেবা সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দেশে সাম্প্রতিক সময়ে মোট কর্মসূচী ব্যয়ের অনুপাতে সামাজিক খাত, বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়ের বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ যথাক্রমে ১.৫ এবং ০.১ শতাংশ পয়েন্ট কম। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ মোট বাজেটের যথাক্রমে ১৩.১ শতাংশ এবং ৪.৪ শতাংশ থেকে কমে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যথাক্রমে ১১.৬ এবং ৪.৩ শতাংশ হয়।
'উন্নয়ন অন্বেষণ' দেখায় যে জিডিপি'র অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ থেকে পিছিয়ে রয়েছে। পরিসংখ্যানমতে ২০১৩ সালে যেখানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমান তার জিডিপি'র মাত্র ৩.৭ শতাংশ সেখানে ভারত, ভিয়েতনাম, নেপাল, কম্বোডিয়া, ও মালদ্বীপে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমান তাদের নিজ নিজ জিডিপি'র যথাক্রমে ৪, ৬, ৬, ৭.৫, ও ১০.৮ শতাংশ।
ফলে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমান অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে অনেক কম। যেমন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমান যেখানে মাত্র ৩২ মার্কিন ডলার সেখানে তা ভারত, ভিয়েতনাম, নেপাল, কম্বোডিয়া, ও মালদ্বীপে যথাক্রমে ৬১, ১১১, ৩৯, ৭৬, ও ৭২০ মার্কিন ডলার।
সরকারি বিনিয়োগের অপ্রতুলতার পাশাপাশি বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি ব্যয়ের অনুপাতে আউট-অফ-পকেট ব্যয়ের পরিমান অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩ সালে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি ব্যয়ের অনুপাতে আউট-অফ-পকেট ব্যয়ের পরিমান ৯৩ শতাংশ হয় যা ভারত, ভিয়েতনাম, নেপাল, কম্বোডিয়া, ও মালদ্বীপে যথাক্রমে ৮৫.৯, ৮৫, ৮১.৪, ৭৫.১, ও ৮৮.৩ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দেখায় যে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে জিডিপি’র অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের পরিমান ১৬.৭৯ শতাংশ ছিল যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৩২.২১ শতাংশ ছিল। সরকারি ব্যয়ের পরিমানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত (২৭.২৬) ও মিয়ানমার (২৭.১৮) থেকেও পিছিয়ে রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রকাশ করে যে, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রকৃত সরকারি ব্যয় মোট কর্মসূচী ব্যয়ের অনুপাতে অর্থবছর ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ ’তে যথাক্রমে ১৭.১, ১৬.৯, ১৮.৬ ১৮.৪, ১৬.৬ এবং ১৬.১ শতাংশ ছিল। উক্ত খাতে ২০১৪ র্অথবছরে সংশোধিত সরকারি ব্যয়ের পরিমান ১৬.৩ এবং ২০১৫ অর্থবছরে বাজেট ১৫.৬ শতাংশ হয়। ২০১৬ ও ২০১৭ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রক্ষেপিত সরকারি ব্যয়ের পরিমান যথাক্রমে ১৫.৫ এবং ১৫.৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতে হ্রাসমান সরকারি ব্যয়ের পরিমানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ দেখায় যে, এই খাতে প্রকৃত সরকারি ব্যয় মোট কর্মসূচী ব্যয়ের অনুপাতে অর্থবছর ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ ’তে যথাক্রমে ৭.২, ৭.১, ৭.৩, ৭.১, ৬.৬ এবং ৬.৪ শতাংশ ছিল। উক্ত খাতে ২০১৪ র্অথবছরে সংশোধিত সরকারি ব্যয়ের পরিমান ৫.৭ এবং ২০১৫ অর্থবছরে বাজেট ৫.৩ শতাংশ হয়। ২০১৬ ও ২০১৭ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে প্রক্ষেপিত সরকারি ব্যয়ের পরিমান যথাক্রমে ৫.৩ এবং ৫.৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অসামঞ্জস্যতার দিকে নির্দেশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দেখায় যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে অনুন্নয়ন ব্যয় ৬৬.৮১ বিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করা হয় যেখানে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন ব্যয়ের পরিমান ৫৩.২৪ বিলিয়ন টাকা। একইভাবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বর্তমান অর্থবছরে অনুন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দের পরিমান ২০০.৪৪ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়ায় যেখানে উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দের পরিমান মাত্র ১২১.২৬ বিলিয়ন টাকা।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের অসন্তোষজনক হারকে বিবেচনায় নিয়ে ’উন্নয়ন অন্বেষণ’ দেখায় যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই'১৪-মে'১৫ সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর যথাক্রমে মাত্র ৫৬ শতাংশ এবং ৬৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/১১ জুলাই ২০১৫/ আহমেদ