২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১২:০৯

এইডস ঝুঁকিতে প্রবাসী শ্রমিক পরিবার

চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে শিরায় মাদক গ্রহণকারীরা, নারীর তুলনায় পুরুষ তিন গুণ বেশি আক্রান্ত

জয়শ্রী ভাদুড়ী

এইডস ঝুঁকিতে প্রবাসী শ্রমিক পরিবার

প্রতীকী ছবি

সৌদি আরব থেকে বিভিন্ন রকম শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে দেশে ফেরেন চট্টগ্রামের মফিজুর রহমান। কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান তিনি। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন তার স্ত্রী রোজিনা বেগম (৩৭)। স্বামীর মৃত্যুর পর তার এইডস শনাক্ত হয়। ফলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। ভাইয়েরাও তার সঙ্গে সম্পর্কছেদ করেছেন। অসুস্থতার জন্য প্রতি মাসে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় তাকে। রোজিনার মতো অনেকেই এইডস আক্রান্ত হচ্ছেন প্রবাসফেরত ব্যক্তির মাধ্যমে। দেশে এইডস আক্রান্তের ২১ শতাংশই প্রবাসফেরত ব্যক্তি ও তার মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া পরিবারের সদস্য। দেশে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে প্রতি বছরই। এর সঙ্গে প্রবাসী শ্রমিকদের এইডস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এইডস নির্মূলে চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে শিরায় মাদক সেবনকারীরা। নারীর তুলনায় পুরুষ এইডস রোগীর সংখ্যা তিন গুণ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোলের পরিচালক ডা. মো. আমিনুল ইসলাম মিঞা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে  বলেন, ‘চার বছর ধরে সরকারিভাবে এইডস নির্মূলে কর্মসূচি চলছে। এইডস শনাক্তে ২৮টি বুথ বসানো হয়েছে। এতে আগের তুলনায় এইডস রোগী শনাক্ত বেড়েছে। এইডস রোগীর বড় অংশ প্রবাসফেরত শ্রমিক, তাদের পরিবার ও শিরায় মাদক গ্রহণকারী। এ ছাড়া যৌনকর্মীদের মধ্যেও এইডস সংক্রমণ রয়েছে। এইডস নির্মূল প্রোগ্রামের আওতায় রোগী শনাক্ত, চিকিৎসা ও তাদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। করোনা সংক্রমণের এই সময়ে রোগীদের বাড়িতে ওষুধ কুরিয়ার করেও পাঠানো হয়েছে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল এইডস-এসটিডি প্রোগ্রামের (এনএএসপি) তথ্যানুযায়ী, দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার। গত বছর এইডস আক্রান্ত ৯১৯ জন শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১০৫ জন। নতুন আক্রান্তের মধ্যে ১৭০ জন মারা গেছেন। ১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয়। ’৮৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশে এইডস আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৩৭৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৩৪২ জন। দেশে একজন এইডস আক্রান্ত রোগীর জন্য সরকারের মাসে খরচ হয় ৬-২০ হাজার টাকা। শিরায় মাদক গ্রহণকারী ও প্রবাসীদের কারণে এইডসের বিস্তার কমানো এখনো চ্যালেঞ্জ। এইডস আক্রান্তের ৬০ শতাংশ মাদক গ্রহণকারী আর ২৭ শতাংশ বিদেশফেরত। দেশের ২৩ জেলায় এইডস আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। ইনজেকশন দিয়ে মাদক গ্রহণকারীর মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। এদের ২২ শতাংশের শরীরে এইচআইভির জীবাণু আছে।

কুয়েতে কর্মরত ছিলেন সিলেটের মারুফুল ইসলাম (৫৫)। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরলে অসুস্থতা দেখা দেয়। পরীক্ষায় তার শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তার স্ত্রীর রহিমা বেগমকে টেস্ট করালে তারও এইডস শনাক্ত হয়। এ সময় তার স্ত্রী তিন মাসের গর্ভবর্তী ছিলেন। সরকারি চিকিৎসা কর্মসূচির আওতায় নিয়মিত ফলোআপে রাখা হয় রহিমা বেগমকে। সন্তান প্রসবের পর শিশুটির শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি পাননি চিকিৎসকরা। তবে মারুফুল ইসলাম ও রহিমা বেগম বাড়িতে থেকে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (এমবিডিসি) ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যৌন সচেতনতা বাড়াতে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীনে ঢাকাসহ প্রতি জেলায় ৭০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এইচআইভি-বিষয়ক কারিকুলাম তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বিদেশে গিয়ে শ্রমিকরা নিজেকে কীভাবে এইডস থেকে নিরাপদ রাখতে পারেন সে বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়েছে। আমরা সেখানে দুটি সেশনে তাদের তথ্য দিয়ে থাকি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকরা এইডস আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরলে তাদের স্ত্রীও আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তারা সন্তান গ্রহণ করলে নবজাতক যেন এইচআইভি পজিটিভ না হয় সেজন্য বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালে আমাদের নিয়মিত চিকিৎসাসেবা চালু আছে। এ পর্যন্ত ১০৯ জন নারী এইডস পজিটিভ অবস্থায় সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তার মধ্যে ১০৭ নবজাতক এইডস নেগেটিভ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। নিয়মিত চিকিৎসায় রাখার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। এ দেশের মোট জনসংখ্যার এইডস আক্রান্তের সংখ্যা দশমিক ১ শতাংশেরও কম। রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশা চালাতেন বিক্রমপুরের সাইফুল ইসলাম (৪৪)। চানখাঁরপুলে স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে শিরায় ইনজেকশন দিয়ে মাদক নিতেন তিনি। বছর দেড়েক মাদক নেওয়ার পর ২০১৪ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন হঠাৎ। রক্ত পরীক্ষায় এইডস শনাক্ত হয় তার। এ খবর শুনে স্ত্রী-সন্তান তাকে ছেড়ে গেছেন। সম্পর্ক রাখেননি স্বজনরা। প্রতিবেশীরাও তাকে বাড়িতে থাকতে দেন না। রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে পাঁচ বছর ধরে চিকিৎসাধীন আছেন সাইফুল। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি থাকা আটজন রোগীই পুরুষ। আউটডোরে এইডস চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর অধিকাংশই পুরুষ। নতুন আক্রান্তের ৭৪ শতাংশ পুরুষ, ২৫ শতাংশ নারী ও ১ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের। ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এইডস আক্রান্তের হার বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক কম। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে আমাদের দেশে এইডস রোগী কম। আর আমাদের প্রবাসীরা কাজের জন্য বিদেশে যান, অজ্ঞতার কারণে এইডস আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে তারা অনুতপ্ত হন। তাই তাদের থেকে অন্যের মধ্যে ছড়ায় কম। শিরায় মাদক সেবনকারীরাই এখন প্রধান সমস্যা। তাদের নিডল শেয়ার করা থেকে বিরত রাখতে পারলে এইডসের ঝুঁকি আরও কমবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর