পরিবারের পক্ষ থেকে মৃত্যু নিশ্চিত করা হলেও পলাতক দেখিয়ে হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস বহাল রাখছে বাংলাদেশ পুলিশের সদর দফতর। মাহমুদুর রহমানই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী কি না তা-ও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তবে সাভারে মাহমুদুর রহমান নামে দাফন হওয়া লাশটি হারিছ চৌধুরীর নাকি তার ছোট ভাই সেলিম চৌধুরীর তা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলছেন, হারিছ চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি আদালত কোনো আদেশ দেয় তবেই তারা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য লাশ কবর থেকে তুলবেন। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দুটি লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাটে দাফন হওয়া হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই সেলিম চৌধুরীর এবং সাভারের বিরুলিয়ায় মাহমুদুর রহমান নামে দাফন হওয়া লাশের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হবে।
সিআইডি-সূত্র জানান, এ বছর ১৯ জানুয়ারি হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিশ্চিত হতে সিআইডিকে একটি চিঠি দেয় পুলিশ সদর দফতর। এরপর সেটি তদন্ত শুরু করে সিআইডির ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ বিভাগ। ২৫ জানুয়ারি এ বিভাগ থেকে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে ১৮ মার্চ পুলিশ সদর দফতরে চিঠি পাঠায় সিআইডি। এ চিঠির বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়। তা ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি তদন্ত করেছিল সিআইডি। ওই সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হারিছ চৌধুরীসহ ওই মামলার পলাতক কয়েক আসামির বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারির আবেদন করা হয়েছিল ইন্টারপোলে। কিন্তু তারা তদন্ত করে যে চিঠি দিয়েছেন তাতে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা নেই। তাই আমরা ইন্টারপোলের রেড নোটিস বহাল রাখছি।’ তবে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান খান এ বিষয়ে কোনো কিছু জানাতে রাজি হননি। সিআইডি-প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ‘হারিছ চৌধুরীর ডিএনএ টেস্টের বিষয়ে আমরা অনলাইনে একটি চিঠি পেয়েছি। কিন্তু এ চিঠির ওপর ভিত্তি করে অ্যাকশন নেওয়া যায় না।’ তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের নথিতে হারিছ চৌধুরী মৃত নন। মৃত হিসেবে নথিভুক্ত আছেন মাহমুদুর রহমান। আর এই মাহমুদুর রহমানের লাশটিই হারিছের বলে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা চৌধুরী। কারণ হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর কোনো নথি না থাকলে তার নামে থাকা সম্পদ তার সন্তানদের নামে কোনো দিন খারিজ হবে না। আবার মাহমুদুর রহমানই যে হারিছ চৌধুরী তা নিয়েও আরেক ধরনের রহস্য দেখা দিয়েছে। কারণ এক মাসের ব্যবধানে হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই সেলিম চৌধুরীরও মৃত্যু হয়। সেলিম চৌধুরীর বাসা রাজধানীর শান্তিনগরের কনকর্ড টাওয়ারে। ব্রেন স্ট্রোকে তার মৃত্যু হলে সিলেটের কানাইঘাটে তাকে দাফন করা হয় বলে স্বজনরা দাবি করছেন। এমনও হতে পারে সেলিমের লাশটিও মাহমুদুর রহমানের বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার সেলিমের নামে কবরে অন্য কারও লাশ থাকতে পারে। কারণ হারিছের সন্তানদের সঙ্গে সেলিমের লাশেরও ডিএনএ নমুনা মিলবে। যদি কখনো আদালত ডিএনএ নমুনার আদেশ দেয় তাহলে দুই কবরের লাশই তোলা হবে। কারণ হারিছ চৌধুরী যখন মারা যান তার মৃত্যু ও দাফনের বিষয়টি নিয়ে পরিবারের লুকোচুরির কারণে এসব সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন এটি সত্য। তবে তার মৃত্যু সংবাদ গোপন কেন করা হয়েছিল তা তার মেয়ে ভালো জানে। কারণ সে সব করেছে। আর সেলিম চৌধুরীর মৃত্যুর সময় আমি আমেরিকায় ছিলাম। তার দাফন হয়েছে কানাইঘাটের দর্পণনগরে।’ এদিকে মরহুম সেলিম চৌধুরীর স্ত্রী সুমি চৌধুরী এই প্রতিবেদককে জানান, তার স্বামী গত বছরের ৫ অক্টোবর ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান। মৃত্যুর পরই তার লাশ গ্রামের বাড়ি সিলেটে নেওয়া হয়। তার স্বামীর মৃত্যুর সামগ্রিক বিষয় জানতে পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল বলে তিনি জানান। সিআইডি-সূত্র বলছেন, পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী হারিছ চৌধুরী ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা যান গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর। এর আগে ১১ বছর মাহমুদুর রহমান নামে ঢাকার পান্থপথের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছিলেন তিনি। এ বাসায় তার শ্যালিকা নিশার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। লাশ সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের জালালাবাদের কমলাপুর এলাকায় জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদরাসার কবরস্থানে ৪ সেপ্টেম্বর দাফন করা হয়। দাফনের সব আয়োজন করেছিলেন হারিছ চৌধুরীর শ্যালক জাফর ইকবাল মাসুম। মিরপুর-১০-এর বেনারসি পল্লীর শওকত কাবাবের পাশের গলির ‘লস্কর বাড়ি’ নামে তিন তলা বাড়িটি তার। এদিকে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর এভারকেয়ার থেকে মাহমুদুর রহমান নামে যে মৃত্যুসনদ নেওয়া হয়েছে, তার ঠিকানা লেখা হয় রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর রোডের একটি বাসার ২বি ফ্ল্যাট। সেখানে ২বি নম্বরের কোনো ফ্ল্যাট নেই। তবে এবি-২ নম্বরের একটি ফ্ল্যাট আছে। সেই ফ্ল্যাটের মালিকের নাম মাহমুদুর রহমান এবং তিনি জীবিত আছেন। মাহমুদুর রহমান নামে যে পাসপোর্ট নেওয়া হয়েছে সেখানে জন্ম তারিখ দেওয়া হয়েছে ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। বাবা মৃত আবদুল আজিজ। মা মৃত রোকেয়া বেগম। এ পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। আর এসব কাগজপত্র তৈরিতে সহায়তা করেন শ্যালক মাসুম। এই মাসুম হারিছ চৌধুরীর নামে থাকা একটি দুর্নীতি মামলার আসামি ছিলেন। আর হারিছ চৌধুরীর নামে থাকা নথিতে তার জন্ম তারিখ ১৯৫২ সালের ১ নভেম্বর। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আত্মগোপনে চলে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরী। এরপর তাকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা হয়। ১৪ বছর ধরে এ নোটিস ঝুললেও তার অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না বা তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। গতকাল ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে গিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন অপরাধে পলাতক বাংলাদেশের রেড নোটিসধারী ৬৩ জনের তালিকায় ছবিসহ হারিছ চৌধুরীর নাম ১৬ নম্বরে রয়েছে। সেখানে তার নাম লেখা রয়েছে চৌধুরী আবুল হারিছ । এতে তার জন্ম তারিখ, জন্মস্থান, জাতীয়তা, উচ্চতা, ওজন, চুল ও চোখের রংসহ শারীরিক বিবরণ রয়েছে। রেড নোটিসে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ২১ আগস্টের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে।