গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের বিচার এবং শাস্তির বিধান রেখে দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধিত হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩। সংশোধিত নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের নিবন্ধন বাতিল, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা পেল ট্রাইব্যুনাল।
গত শনিবার গেজেট আকারে প্রকাশিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল, অধিকতর সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ এই বিধান সংযুক্ত করা হয়। সংসদ ভাঙা থাকায় রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ জারি করেন।
এতে বলা হয়, কোনো সংগঠন যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে নির্ধারিত অপরাধ; যেমন—গণহত্যা, নিপীড়ন, গুম, মানবপাচার ইত্যাদিতে যুক্ত থাকে, তা প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে পারবে; পাশাপাশি তাদের নিবন্ধন বাতিল এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও ক্ষমতা থাকবে।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সংশোধনী : সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। গত ৮ মে রাতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ডাকে (দলটির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে) যমুনা ভবনের সামনে অবস্থান নেয় একদল আন্দোলনকারী। এই কর্মসূচিতে পরে জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংগঠনও যোগ দেয়। ৯ মে শাহবাগ অবরোধ করে তিন দফা দাবি তুলে ধরে তারা।
আন্দোলনের চাপে ওই রাতেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে বসে। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন অনুমোদন পেয়েছে এবং দ্রুত তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। এর কয়েক ঘণ্টা পরই অধ্যাদেশ জারি হয়।
কী আছে সংশোধিত আইনে
১৯৭৩ সালের আইনের ২ ও ২০ ধারায় পরিবর্তন এনে নতুন দুটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে।
ধারা-২-এ যুক্ত নতুন উপধারায় ‘সংগঠন’ বলতে বোঝানো হয়েছে রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন, সংশ্লিষ্ট বা সহযোগী কোনো সত্তা কিংবা ট্রাইব্যুনালের মতে, যার কার্যক্রম অপরাধে সহায়তাকারী।
ধারা-২০(খ)-তে বলা হয়েছে, যদি ট্রাইব্যুনাল মনে করে, কোনো সংগঠন অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ দিয়েছে, সহায়তা বা প্ররোচনা দিয়েছে, তাহলে সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ বা তার কার্যক্রম স্থগিত করা যাবে; এমনকি নিবন্ধন বাতিল এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করাও সম্ভব হবে।
প্রসিকিউটরের প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, সংগঠনের শাস্তির বিধান রাখা এই সংশোধন সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালের সংশোধন আইনে সংগঠনের বিচার সম্ভব হলেও শাস্তির বিধান ছিল না। এবার তা যুক্ত হওয়ায় বিচার ও শাস্তি উভয়ই সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গ : আওয়ামী লীগ সরকারের বিচার
আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এর শাসনামলে গুম, খুন, নির্যাতনসহ যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আইনে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা বিস্তৃত’ করা হয়।
গত বছরের ২৫ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ শিরোনামে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ওই অধ্যাদেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক ক্ষমতার পরিসর আরো বিস্তৃত করা হয়। এতে গুম ও মানবপাচারের মতো অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধের আওতায় আনা হয়, যা আগের আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না।
এ ছাড়া সংশোধিত আইনে শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞাও বিস্তৃত করা হয়। আগে যেখানে শুধু সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের বিচার সম্ভব ছিল, এখন সেখানে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, আনসারসহ আইনি ভিত্তিতে গঠিত যেকোনো বাহিনী এবং তাদের সদস্যদেরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় আনা সম্ভব হবে। নতুন সংশোধনীতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও এর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
শুধু তা-ই নয়, প্রথম অধ্যাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞাও বিস্তৃত করা হয়েছে, যাতে অতীতের মতো ব্যাখ্যার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে দায় এড়ানোর সুযোগ না থাকে।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম