৭ আগস্ট, ২০২০ ১৫:৫১
ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ হোম অফিসের

যুক্তরাজ্যে ১৭ বছর ধরে মামলা লড়ছেন বাংলাদেশের সাইফুল

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যে ১৭ বছর ধরে মামলা লড়ছেন বাংলাদেশের সাইফুল

বাংলাদেশি শেফ সাইফুল ইসলাম নির্দোষ হয়েও ১৭ বছর ধরে মামলা লড়ে যাচ্ছেন ব্রিটেনে হোম অফিসের বিরুদ্ধে। তার এই সংগ্রামের কাহিনী ব্রিটেনের বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন মূলধারার পত্রিকায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছে। তবে হোম অফিস তাদের ভুল স্বীকার করেছে, সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছে এবং ৬ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছে তাকে। 

সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি এই দেশে এসেছিলাম পূর্ণ যৌবনে। আমার জীবন থেকে যৌবনের ১৭ বছর হারিয়েছে হোম অফিসের ভুলের কারণে। ৬ হাজার পাউন্ড দিয়ে কী সেই ১৭ বছরের হারানো জীবনের তুলনা হয়?

বাংলাদেশের পটুয়াখালীর বাসিন্দা ৪৪ বছর বয়স্ক সাইফুল ইসলামকে ব্রিটেনের পুলিশ ভুল করে যৌন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করে। এই অভিযোগে তাকে ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করার নিদের্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সাইফুল ইসলাম এই আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেন। এখন পর্যন্ত এই মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। তবে হোম অফিস তার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে।

২০০২ সালের নভেম্বরে তিনি স্ট্রাফোর্ডশায়ারের একটি থাই-ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে আসেন ওয়ার্ক পারমিটে। ২০০৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ওয়ার্ক পারমিট পান একই রেস্টুরেন্ট থেকে। ২০০৫ সালেই এই রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে মডার্ন স্লেভারীর অভিযোগ করেন হোম অফিসে। 

সাইফুল ইসলাম ওই সময়ের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, হোম অফিস এনফোর্সমেন্ট ওই সময় রেস্টুরেন্টে হানা দেয় এবং সেই রেস্টুরেন্ট মালিকের ওপর কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে দেয়! কিন্তু সেই নোটিশ তিনি পাননি। এরপর থেকেই শুরু হয় নানা সমস্যার।হোম অফিসের পরামর্শেই তিনি নতুন আরেক রেস্টুরেন্ট থেকে ওয়ার্ক পারমিট নেন। আবেদন করেন, সেটি মঞ্জুরও হয়। বিপত্তি বাজে যখন তিনি ইন্ডিফিনিট লিভ টু রিমেইন এর জন্য আবেদন করেন, তখন! সেসময় হোম অফিস তাকে একজন ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গকারী হিসেবে দায়ী করে। এই আইনি লড়াইয়ের মধ্যেই ঘটে আরেক বিপত্তি।

সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকারি দপ্তরে থাকা তার কাগজপত্র কোনোভাবে মিশে গিয়েছিল অন্য তিনজন লোকের সঙ্গে। যাদের একজন ছিলেন সেক্স অফেন্ডার। তার ফলে কোনো দোষ না করেও আমাকে সেক্স অফেন্ডার হিসেবে অপরাধী করা হয়। পুলিশ যে ভুল করেছে ব্রিটেনের প্রসিকিউশন তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এরপরও মামলাটি চলমান রেখেছে কর্তৃপক্ষ।  

ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা ‘হোম অফিস’ ইতিমধ্যে এই ভুলের জন্য আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর পরও তাকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। তিনি যুক্তরাজ্যে থাকার জন্য ১৭ বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি সাইফুল ইসলামকে নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী ফিজা কুরেশি বলেন, সাইফুল যদি ১৭ বছর ধরে মামলা লড়ে না যেতেন, তাহলে তার জানাই হতো না যে হোম অফিস তার কাগজপত্র গুলিয়ে ফেলেছে এবং তাকে ভুলভাবে একজন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

বিবিসির ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সাইফুলের বিষয়ে তথ্য কমিশনারের মাধ্যমে তার ফাইল দেখার সুযোগ পান এবং তাতে ভুলও ধরা পড়ে। ২০১৯ সালে তার কাছে এজন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়। 

সাইফুল ইসলাম বলেন, হোম অফিস আমাকে মানুষ বলে মনে করেনি। তারা এমন আচরণ করেছে যেন আমি একজন অপরাধী। আমি এজন্য অনেক বছর হারিয়েছি, আমার স্বাস্থ্য ও অর্থ হারিয়েছি।

এ জন্য তিনি মানসিক বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এ সংক্রান্ত এক বিচারবিভাগীয় পুনর্বিবেচনার রায়ে বলা হয় ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য সাইফুল ইসলামের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে ভিত্তি ছিল ২০০৮ সালের একটি প্রত্যাখ্যাত আবেদন। কারণ, সে সময় তার কোনো ওয়ার্ক পারমিট ছিল না। হোম অফিসের ভুল তার সিদ্ধান্তের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি।

তিনি জানান, ২০০৮ সালে তার কোনো ওয়ার্ক পারমিট না থাকার কয়েকটি কারণ ছিল। একটি হচ্ছে তাকে ভুলভাবে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা। তা ছাড়া তার ফাইলের কিছু অংশ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে এবং অন্য একটি মামলায় তা আদালতে উত্থাপন করা হয়নি। তিনি যে আইনসঙ্গতভাবে ব্রিটেনে প্রবেশ করেছিলেন তার প্রমাণ হিসেবে তার পাসপোর্টের প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠাগুলোও আদালতকে দেওয়া হয়নি। এরপর বিচারপতি জ্যাকসন রুলিং দেন যে, সাইফুল ইসলামের আবেদনের ক্ষেত্রে অতীতে কিছু ভুল ও অবিচার করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোই তার বর্তমান অবস্থার কারণ বলে সাইফুল ইসলাম যে দাবি করছেন তা দলিলপত্রে প্রমাণ হয় না। রুলিংয়ে আরও বলা হয়, এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই যে তাকে কোনো একটি বিশেষ পদে নিযুক্ত রাখা এখনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সাইফুল ইসলাম জনান, তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের পরিকল্পনা করছেন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১৮টি মামলা এবং হোম অফিসের বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে। হোম অফিস বলছে, তারা কোনো চলমান আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করবে না। তবে তারা এটা নিশ্চিত করেছে যে সাইফুল ইসলামের বিবরণের সঙ্গে অন্য তিনজন লোকের বিবরণ ‘ভুলক্রমে’ যুক্ত হয়ে গেছে। 

হোম অফিস আরও বলেছে যে, ব্রিটেনে বসবাসের প্রতিটি আবেদনই স্বতন্ত্রভাবে অভিবাসন আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা হয়। কারও এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি না থাকলে এটাই আশা করা হয়, তিনি স্বেচ্ছায় চলে যাবেন। যদি তা না করেন তাহলে এদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে। এমন এক পরিস্থিতিতে এই বাংলাদেশি নাগরিক দেশটিতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিডি প্রতিদিন/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর