৪ অক্টোবর, ২০২১ ১২:০০

পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনার নাম পঞ্চগড় : প্রয়োজন কম্যুনিটি ট্যুরিজম

ড. সাবিনা ইয়াসমিন

পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনার নাম পঞ্চগড় :  প্রয়োজন কম্যুনিটি ট্যুরিজম

ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ

ফরাসি লেখক গুস্তাভে ফ্লুবার্ট বলেছেনে, ‘ভ্রমণ মানুষকে পরিমিত করে। আপনি দেখতে পান যে আপনি পৃথিবীতে কত ছোট জায়গা দখল করেছেন।’ তবে শুধু নিজের ক্ষুদ্রত্ব উপলব্ধির জন্য নয়, বরং পৃথিবীর বিশালত্ব উপভোগ করার জন্যেও ভ্রমণের বিকল্প নেই। সাধারণত: বিনোদন, অবসর বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করাকে ভ্রমণ বলে। তবে আমোদ-প্রমোদ বা বিনোদনের উদ্দেশ্যে কোথাও ভ্রমণ করা হলে তা’ পর্যটনের মাত্রা পায়। আর যিনি এ উদ্দেশে ভ্রমণ করেন তিনিই পর্যটক হিসেবে পরিচিত।
 
       শুধু ভ্রমণ করেই বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়েছেন বহু পর্যটক। ভ্রমণ করতে করতেই আবিষ্কার করেছেন কোন মহাদেশ, কোন ভৌগলিক অঞ্চল বা কোন চ্যানেল বা প্রণালী। স্যার এডমন্ড হিলারি, ইউরি গ্যাগারিন, মার্কো পোলো, ভাস্কো-দা-গামা প্রমুখ খ্যাতি পেয়েছেন বিশ্ব ভ্রমণ বা বিশ্বের গণ্ডি পরিয়ে মহাকাশ ভ্রমণের জন্য।
 
বিজ্ঞানী চার্লস ডারইউন বিবর্তনতত্ত্বের জনক হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেলেও পর্যটক হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। তিনি পেরুর মরুভূমি ও আর্জেন্টিনার সমতল ভূমির পাশাপাশি প্যাসিফিক, আটলান্টিক ও গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ করেন, যা তাকে প্রাণিতত্ত্ব আবিষ্কারে সহায়তা করে। 
 
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে বহ ভ্রমণকারী এ দেশ ভ্রমণ করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মপুস্তক ‘বিনয়াপিটক’ এর মূল রচনা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে চীনা ধর্মীয় তীর্থ যাত্রী ফা হিয়েন দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্তের সময়ে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি ট্যাক্সিলা, মথুরা, কনৌজ, পাটালিপুত্রের পাশাপাশি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলংকার বহু ধর্মীয় স্থান ভ্রমণ করেছিলেন।
 
মরক্কোয় জন্ম গ্রহণকারী বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক, চিন্তাবিদ, বিচারক ইবনে বতুতাও বর্তমান পশ্চিম আফ্রিকা, মিশর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, শ্রীলংকার পাশাপাশি বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছিলেন। ৩০ বছরে প্রায় ৪০টি স্থান ভ্রমণ শেষে নিজ দেশে ফেরার পর মরক্কোর সুলতান আবু ইনান ফারিস তাঁর ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য কবি ইবনে ফোজাইয়াকে নিয়োগ করেন। তাঁর এই ভ্রমণকাহিনীর নাম ‘রিহলা।’ যা ১৪ শতকে দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম সমাজের অন্যতম সেরা দলিল হিসেবে বিবেচিত।
 
বর্তমান সময়ে বাংলাদশে পর্যটনের একটি সম্ভাবনাময় জেলার নাম পঞ্চগড়। দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের শেষপ্রান্তে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জেলাটি  ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত একটি থানা ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পঞ্চগড় থানাকে দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও মহকুমার পাঁচটি থানা- পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী, বোদা ও দেবীগঞ্জ নিয়ে পঞ্চগড় জেলা ঘোষিত হয়। এ জেলায় পাঁচটি গড় আছে। তাহলো-রাজনগড়, মিরগড়, ভিতরগড়, দেবেনগড় ও হোসেনগড়। কথিত মতে, এই পঞ্চগড়ের সমন্বয়েই হয়েছে জেলার নাম পঞ্চগড়। তবে এই ‘পঞ্চগড়’ নামের অপভ্রংশ ‘পঞ্চগড়’ নামটিও দীর্ঘদিন এ জনপদে প্রচলিত ছিল।
 
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই জেলাটি পর্যটনের জন্য ক্রমশঃ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। দেশী-বিদেশী সৌন্দর্য পিপাসু বহু মানুষের পঞ্চগড়ে সমতলের চা বাগান দেখতে আসছেন। 
 
‘ভারতের শিলিগুড়িতে যদি চা চাষ হতে পারে, তাহলে পঞ্চগড়ে কেন নয়?’-  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই একটি চিন্তা থেকে নব্বই এর দশকে  তারই  নির্দেশে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ রবিউল ইসলাম ভারত থেকে চায়ের চারা সংগ্রহ করে এনে জেলা প্রশাসকের বাংলোতে রোপণ করেন। চারাগাছটি খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষুদ্র-বৃহৎ বহু উদ্যোক্তাই এগিয়ে এসেছেন চায়ের উৎপাদনে। এ জেলায় এখন প্রায় ৭৫৯৮ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ভ্রমণকালে রাস্তার দু’পাশে যেদিকে চোখ যায়, দেখা যায় দিগন্ত-বিস্তৃত চা বাগান। সবুজ, শ্যামল, সুন্দর, সুবর্ণ, রূপসী, অনন্য। সৌন্দর্য পিপাসু মনের খিদে মেটানোর এক অপরূপ ভূ-চিত্র। 
 
চায়ের পাশাপাশি দিগন্ত-বিস্তৃত সবুজও (আলু, টমেটো, ভুট্টা, গম, ধান, সর্ষে ইত্যাদির ক্ষেত) নিসর্গ-প্রেমীদেরকে মুগ্ধ করে। 
 
হিমালয়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত জেলাটিতে রয়েছে বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর। বন্দরটি দেশের চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর, যার মাধ্যমে চারটি দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান) সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ভারতের সাথে ইমিগ্রেশন চালু হওয়ায় বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে দার্জিলিং, কালিম্পং, মংপু, ডুয়ার্সসহ আকর্ষণীয় স্থানে ভ্রমণ সহজ হয়েছে। এই স্থলবন্দর দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে আমদানী-রপ্তানি কার্যক্রম চলমান।
 
এছাড়া এ জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায় রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ডাক-বাংলো। পঞ্চগড় জেলা সদর হতে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরে মহানন্দা নদীর পাশে এই ডাক-বাংলোটি অবস্থিত। ভিক্টোরিয়ান গঠন শৈলিতে নির্মিত ডাক-বাংলোটি কুচবিহারের রাজা নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ ডাক-বাংলোতে জাতীয় চার নেতা বৈঠক করেছিলেন। এছাড়া এ অঞ্চলটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে না পারায় এটিকে ‘মুক্ত অঞ্চল’ বলে ঘোষণা করা হয়। শীতের প্রারম্ভে অর্থাৎ হেমন্তে এই ডাক-বাংলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কুয়াশামুক্ত নীল আকাশে কখনও সোনালি, কখনও শুভ্র সাদা আবার কখনও বা হালকা বেগুনি রঙ ধারণ করে দৃশ্যমান থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার গরবিনী চূড়া। এই নান্দনিক সৌন্দর্য পর্যটকদের নির্মল আনন্দ দেয়।
 
এছাড়া এ জেলার প্রায় ৩,২০,০০০ বর্গগজের ১০ টি ঘাট বিশিষ্ট মহারাজার দিঘি দর্শকদের কাছে টানে। ২০ ফুট উচ্চ পাড় এর দিঘিটিতে পানির গভীরতা প্রায় ৪০ ফুট। কথিত আছে, এই দিঘির খননকারী রাজা পৃথু এবং তিনি একবার ‘কীচক’ নামে এক নিম্ন শ্রেণির আক্রমনের শিকার হয়ে তাদের স্পর্শে ধর্মনাশের ভয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে এই দিঘিতে আত্মহনন করেন। 
 
পঞ্চগড় জেলার সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় চত্বরে একটি রকস মিউজিয়াম আছে। ২০০০ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ মোঃ নাজমুল হক জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রায় ১০০০ লোকজ বস্তুর সংগ্রহে এটি নির্মাণ করেন।  ভিতরগড়  (যার আয়তন প্রায় ১২ বর্গ মাইল), ১৬৭৯ (সম্ভাব্য) খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আটোয়ারি উপজেলার শাহী মসজিদ, একই উপজেলার বারো আউলিয়া মাজার শরীফ ও  জগবন্ধু ঠাকুর বাড়ি প্রভৃতি স্থানসমূহের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব পঞ্চগড় জেলাকে পর্যটনের উপযুক্ত করেছে। 
 
এ জেলায় হিন্দু ধর্মাবলবীদের তীর্থস্থান বোদেশ্বরী মন্দির রয়েছে। এটি একটি সতীপীঠ। রাজা দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে শিবকে আমন্ত্রণ না জানানোয় দেবী দুর্গা ক্ষোভে দেহ ত্যাগ করলে শিব উন্মত্তের মতো সেই শবদেহ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে থাকেন এবং প্রলয় সৃষ্টি করেন। সে মুহূর্তে স্বর্গের রাজা বিষ্ণু তা সহ্য করতে না পেরে স্বর্গ হতে একটি সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করেন। চক্রের স্পর্শে শবদেহটি একান্ন (মতান্তরে বায়ান্নো) খণ্ডে বিভক্ত হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি ও অপর একটি খণ্ড পঞ্চগড়ের বোদেশ্বরীতে পড়ে। মহামায়ার দেহের খণ্ডগুলো যেখানে পড়ে সেগুলিকে পীঠ বলা হয়। বোদেশ্বরী মহাপীঠ এরই একটি। করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে নির্মিত বোদেশ্বরী মন্দিরটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের নিদর্শন বহন করে। 
 
পর্যটনের জন্য স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চগড় জেলায় রয়েছে নানা রকম সুস্বাদু খাবার। এর মধ্যে সিঁদলের ভর্তা, নাপা শাকের পাতলা ঝোল, সজনে পাতার পদ, নোনতা স্বাদের নুনহাস পিঠা পর্যটকদের তৃপ্তি দিতে পারে।
 
তবে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে পঞ্চগড় খুব আকর্ষণীয় স্থান হলেও পরিবার-পরিজন বা কয়েকটি পরিবার একসাথে যেতে হলে পূর্ব থেকে খোঁজখবর নিয়ে যাওয়া ভাল। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তেঁতুলিয়া ডাক-বাংলো এবং ডাক-বাংলো চত্বরে জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তহবিলে নির্মিত ‘বেরং কমপ্লেক্স’ ছাড়া বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলা শহরে কিছু কটেজ বা হোটেল রয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে শীতের প্রারম্ভে পর্যটকের ভিড় থাকায় স্থান সংকট মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় পর্যটনের জন্য রেস্ট হাউস নির্মাণের পাশাপাশি কমিউনিটি পর্যায়ে পর্যটনকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। স্থানীয় উদ্যোক্তাগণ তাদের হোম এবং ফুড শেয়ারিং এর মাধ্যমে অতিথিদের পঞ্চগড় এর সৌন্দর্য দেখার সুযোগ করে দিতে পারেন। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কথাটিও মাথায় রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে এ ধরনের উদ্যোক্তাগণের তালিকা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে থাকলে এবং অতিথিদের আগমন ও প্রস্থান বিষয়ক রিপোর্ট উদ্যেক্তাগণ প্রশাসনকে জানিয়ে রাখতে পারেন। 
 
পৃথিবীতে পর্যটন শিল্প আজ অন্যতম বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। এ শিল্প বিকাশের ওপর বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অনেকখানি নির্ভর করছে। পর্যটনের ক্ষেত্র সমূহকে চিহ্নিত করে (উল্লেখযোগ্য স্থান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি) আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনসহ সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই কেবল এ শিল্পের অধিকার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।
 
 
লেখক : উপসচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়
কবি।
 
ইমেইলঃ [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর