২৭ আগস্ট, ২০২২ ২২:৪৫

পর্যটন খাতে হোক গতিশীল অর্থনীতির সঞ্চার

মীর মাহফুজুর রহমান

পর্যটন খাতে হোক গতিশীল অর্থনীতির সঞ্চার

মীর মাহফুজুর রহমান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে সেই উত্তাল জনসভায় বলেছিলেন, "আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।" এ কথার সত্যতা আজ বাঙালী দেখতে পাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী সফলতায়। এই সরকারের আমলে বাংলাদেশে এখন উৎপাদনশীল ও উন্নয়নশীল গণতন্ত্র প্রবাহমান। যা কিনা দেশের টেকসই অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। 

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশ আজ অর্থনীতিতে এশিয়ান টাইগার তথা ইমার্জিং টাইগার। পৃথিবীর সকল দেশকে টেক্কা দিয়ে বাঘের মত গর্জে উঠছে আমাদের অর্থনীতি। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকলেও, আমরা এখনো এই খাতটিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত তেমন সুবিধা করতে পারছিনা। অথচ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত একজন পরিব্রাজক বা ট্রাভেলারের কাছে মনকাড়া দর্শনীয় স্থান দর্শনের অভাব নেই। পদ্মাসেতু পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। পর্যটন উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অন্তরায় যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তাহীনতা। এই বাধাগুলো পার করতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে পর্যটন শিল্পের বিকাশে এক উদাহরণ হয়ে থাকবে। পদ্মাসেতুর কারণে যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সাথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তাই এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন অনিবার্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পর্যটন শিল্পকে তাদের ব্যবসায়ীক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। অথচ পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা এই শিল্পের বিকাশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছিনা। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার অন্যতম টুরিষ্ট প্যারাডাইজ। 

বাংলাদেশের জিডিপিতে ৪% ভূমিকা রাখে যে খাত, সেই খাত হল পর্যটন খাত। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক শক্ত অবস্থানে যাবে বলে আমি আশাবাদী। কিন্তু পর্যটন শিল্পকে সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার উপরই ভিত্তি করে এ শিল্পের সফলতা। 

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে আছে কনকর্ড গ্রুপের "ফ্যান্টাসি কিংডম" ও চট্টগ্রামে অবস্থিত "ফয়ে'স লেক"। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটকদের জন্যও আমরা সমমানের বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন করতে পারি। কুয়াকাটা হতে পারে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য ট্রাভেলারদের জন্য এক বিখ্যাত ট্যুরিষ্ট ডেসটিনেশন। একমাত্র অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কুয়াকাটা হয়ে উঠেনি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক ট্যুরিষ্ট স্পট। এখানে আছে হাজারো নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সম্ভার যা হয়তো লাখো বৈশ্বিক ও দেশীয় পর্যটককে আকৃষ্ট করবে অচিরেই। কুয়াকাটার মাঝে প্রকৃতির নিখুঁত সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে এখন আর হাজারো পর্যটককে কষ্ট করতে হবেনা। এজন্যই বলা হয়, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি দেশের উন্নত জীবনধারণের মান নিশ্চিত করে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ পর্যটন শিল্পই প্রকৃতি নির্ভর। সমুদ্র, পাহাড় আর বনাঞ্চলে ভরপুর পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঠিক যেভাবে পরিকল্পিতভাবে পর্যটকবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলার দরকার ছিল, সেই পরিকল্পনা মাফিক হয়নি বলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ খাত থেকে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, সিলেট আর রাঙামাটিকে পর্যটকেরা যেভাবে ডেসটিনেশন গোল হিসাবে মনে করে, সেভাবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানকে আমরা একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির অভাবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে আকৃষ্ট করতে পারিনি। ভারতের যেমন আছে পর্যটন সিটি "গোয়া", আমরাও পারি অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা পটুয়াখালীকে দক্ষিণের পর্যটন শহর বানাতে। এক পর্যটন খাত থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণের মানুষের জীবন ও জীবিকার ভাগ্য বদল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে পারে। 

এজন্য দরকার সরকারের এ শিল্পের প্রতি সুদৃষ্টি ও দুরদর্শী মহা-পরিকল্পনা। তাহলে দেশের মোট জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্জন ৩০ শতাংশে উন্নিত হতে হয়তো সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বোতকৃষ্ট সংযোজন পদ্মাসেতু। ভাগ্য বদলে দেয়া এই সেতু দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য আশীর্বাদ এ বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে দেখতে যারা আসবেন তারাই হলেন বাংলাদেশে ঘুরতে আসা পর্যটক। তারাই আমার দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বাহক। যে দেশে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেষ্টের মত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আছে, যে দেশে নকশীকাথা আছে, যেদেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে, যেদেশে স্বপ্নের পদ্মাসেতু আছে সেদেশে পর্যটন বিকাশ অবধারিত। 

ভারি শিল্প, প্রবাসীদের রেমিটেন্স বা পোষাকশিল্পের সাথে এক কাতারে পর্যটন শিল্পকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক শক্তি হিসাবে দেখতে চাইলে এখনই এর একটি মেগা-প্ল্যান দরকার। ভৌতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এই খাতে দক্ষ জনবল তৈরীও একটি কি-ফ্যাক্টর বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এর মধ্যে দেশের এগারশ স্পট নিয়ে মাষ্টার প্ল্যান করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার আর্কিটেকচারাল, ষ্ট্র্কচারাল ও ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনার পর্যটন স্পটগুলো অগ্রাধিকার পাবে। যদি এর সঠিক বাস্তবায়ন ঘটে তাহলে পর্যটন শিল্পের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ সুপ্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। 

ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বা দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফাকে পর্যটকরা দেখতে যেভাবে আকৃষ্ট হয়, ঠিক সেভাবে পদ্মাসেতুকেও আকৃষ্ট করানোর জন্য এর একটি সঠিক ও যুগপোযোগী ব্র্যান্ডিং বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করতে হবে। দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ শুধু পর্যটন সুবিধা বাড়িয়ে যেমন তার পর্যটনশিল্পকে দেশের একমাত্র প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির খাত হিসেবে এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে আছে ঠিক তেমনি আমাদেরও সেই অবস্থানে আসার সময় এসেছে। দরকার সঠিক সুপরিকল্পনা, বৃহদাকারে পর্যটন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায়। বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি যাতে বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীণ পর্যটক আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। 

একমাত্র পর্যটনশিল্পে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বড় কোন বৈশ্বিক মন্দা দেখা না দিলে এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তেজীহারে বাড়তে থাকে লাগামহীন ঘোড়ার মত। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ভবিষ্যত বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। 

লেখক: মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব এমিউজমেন্ট পার্ক এন্ড এটরাকশন্স (বাপা)

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

সর্বশেষ খবর