১৭ নভেম্বর, ২০২২ ১৬:৫৪

শতবর্ষে টিএস এলিয়টের 'দ্যা ওয়েস্ট ল্যাণ্ড' : আজও ফুরায়নি আবেদন

মোরশেদুল ইসলাম

শতবর্ষে টিএস এলিয়টের 'দ্যা ওয়েস্ট ল্যাণ্ড' : আজও ফুরায়নি আবেদন

(ডানে লেখক: মোরশেদুল ইসলাম)

গেল বছর বাংলা সাহিত্যের যুগান্তকারী কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। তেমনই আরেকটি যুগান্তকারী কবিতা দ্যা ওয়েস্ট ল্যাণ্ড'র শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে এ বছর। মার্কিন বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাহিত্যিক টিএস এলিয়ট (১৮৮৮–১৯৬৫) রচিত এ কবিতাটি শুধু ইংরেজি সাহিত্যের নয় বরং বিশ্ব সাহিত্যের সম্পদ। মহাকাব্যিক এই কবিতার এক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজও রয়েছে তা প্রাসঙ্গিক।

১০০ বছর আগে লন্ডনের সাহিত্য সাময়িকী দ্যা ক্রাইটেরিয়নে প্রকাশিত হয়েছিল এটি। ৪৩৪ লাইনের কবিতাটি প্রকাশের সাথে সাথেই বিখ্যাত বনে যায়। এতে ভাষা, ধর্ম, প্রাচীন কবিতার তথ্যসূত্র, বই, নাটক, অপেরা এবং সঙ্গীত, বাকপটু বক্তৃতার অনুচ্ছেদ, এমন কী দৈনন্দিন জীবনের কথোপকথনও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে কিউবিজম এবং ফিউচারিজমের মতো শিল্প আন্দোলনের অস্থির শক্তিকে প্রাণবন্ত সুরে এবং শব্দে দেখিয়েছেন কবি।

আধুনিকতাবাদের ক্ষেত্রে কবিতাটি যুগ-সংজ্ঞায়িত। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পরে, ছিন্নভিন্ন বিভিন্ন সাম্রাজ্য এবং বাস্তবতার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় মানুষ কতটা অসহায় বোধ করেছিল তা বিশদভাবে দেখানো হয়েছে কবিতাটিতে। কবিতাটি এলিয়টকে এনে দিয়েছে একজন কঠিন কবির খ্যাতি। একইসাথে পাঠকের সাথে স্থাপন করেছে গভীর যোগাযোগও। কবিতায়, বিভিন্ন কথক এবং চরিত্র পাঠককে প্রবাহমান ল্যান্ডস্কেপ এবং দৃশ্যের মাধ্যমে নিয়ে যায় মরুভূমি, অন্তহীন সমভূমি, তেল ও আলকাতরার নদী, শোভাময় ঘর, কোলাহলপূর্ণ টয়লেট, একটি অবাস্তব শহরের সেতু এবং রাস্তায়। পৌরাণিক কাহিনীর রেফারেন্স কবিতাটিতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।

১৯২২ সালের অক্টোবরে রচিত এবং ডিসেম্বরে গ্রন্থবদ্ধ হওয়া এই কবিতাটি বিংশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মগুলোর অন্যতম। আর সেটা শুধু কাব্য কিংবা সাহিত্য মানের ক্ষেত্রেই নয়। বরং এর ভাব, ব্যাকরণ, এর অনুষঙ্গ এবং এর উত্তেজনা আধুনিক চিন্তাধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বুনন করেছে এবং আমাদের সমকালীন দুনিয়াকে আলোকিত করতে সাহায্য করেছে যেমনটা এলিয়টের সময়েও করেছিল।

দ্যা ওয়েস্ট ল্যাণ্ড একটি ভীষণ দুরূহ রচনা মনে হতে পারে। কারণ এটি অগণিত কণ্ঠে বলা একটি ভাঙা কবিতা। কণ্ঠগুলোয় ধ্বনিত হয় শেইক্সপিয়ার, দান্তে, ওয়াগনার, ভার্লাইন, বাইবেল এবং উপনিষদের সুনির্বাচিত ইঙ্গিত এবং দারুণ সব শিক্ষা।

আফ্রিকান আমেরিকান ঔপন্যাসিক রাল্ফ এলিসন লিখেছিলেন যে যখন তিনি ছাত্র অবস্থায় প্রথম ইলিয়টের দ্যা ওয়েস্ট ল্যাণ্ড পড়েন, তিনি প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলেন। কারণ, ‘এর যে ছন্দ সেটা জ্যাজ মিউজিকের কাছাকাছি প্রায়; এবং অনেক ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ কবিদেরও ছাড়িয়ে যায়।’ ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দাবলির মাধ্যমে ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক দেখা যায় এই কবিতায়। ওয়েস্ট ল্যাণ্ড এমন এক সময়ে লেখা হয়েছিল যখন সামাজিক ও নৈতিক শৃঙ্খলার যোগসূত্রগুলো উন্মোচিত হচ্ছিল। সে সময় একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হত্যাকাণ্ড অন্যদিকে রুশ বিপ্লবের নাটক। ফলে বিশ্ব দাঁড়িয়ে ছিল নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বিপ্লব এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মুখোমুখি।

দ্যা ওয়েস্ট ল্যাণ্ড শুধুই সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক কবিতা নয়। একইসাথে আধুনিকতাবাদের প্রভাব নিয়ে লেখা একটি দুঃখ জাগানিয়া কবিতা। কারণ, এতে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ের ফলে যে নৈতিকতারও অবক্ষয় হয়েছিল তা তুলে ধরা হয়েছে। 

এলিয়টের মনে হতো আধুনিক বিশ্ব মনমরা ও অনুর্বর এক বন্ধ্যা ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখানে মানুষ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করছে এবং এরা শুধুই ব্যক্তিগত লোভ-লালসা দ্বারা চালিত হচ্ছে। তিনি লিখেছেন:
“Here is no water but only rock/ Rock and no water and the sandy road.”

এলিয়টের মনে হচ্ছিল এই আধুনিকতা আনন্দজনক কিছুকেও বোঝায় পরিণত করেছে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই (দ্যা ওয়েস্ট ল্যাণ্ড)'র একেবারে শুরুতেই। কবিতাটি শুরু হয় ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় পঙক্তি দিয়ে:

“April is the cruellest month, breeding,/ Lilacs out of the dead land,”

এপ্রিল মাস নিষ্ঠুর, কারণ বসন্তের আগমন যেটাকে সজীব করে তোলে আধুনিক বিশ্ব সেটাকে বরং সমাহিত হয়ে রাখে; সমাহিত করে রাখে শুধু নতুন কাণ্ড নয়, পুরানো স্মৃতি, ইতিহাস এবং আশাকেও। আশা করতে হলে হতাশা ও পরাজয়ের দরজাও খুলে দিতে হবে। কিন্তু, এলিয়ট বলেন, আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যেটা আশার ভঙ্গুরতার চেয়ে নিন্দাবাদের মৃত্যুময়তাকেই বেশি পছন্দ করে: 

“Winter kept us warm, covering/Earth in forgetful snow.”

দ্যা ওয়েস্ট ল্যান্ডে এলিয়ট আধ্যাত্মিকতার উৎস হিসেবে প্রাচ্যের বৌদ্ধধর্ম এবং সনাতন হিন্দুধর্মের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়েছেন। অবশেষে, তার নৈতিক ভিত্তির জন্য তাকে খ্রিস্টধর্মে যেতে হয়েছিল। একদিকে আধুনিকতার কারণে তার হতাশা জন্মেছিল; অন্যদিকে একটা নৈতিক অবস্থানের খোঁজ করতে করতে তিনি পৌঁছে ছিলেন অন্ধকার জায়গাসমূহে বিশেষ করে নারী বিদ্বেষ এবং ইহুদি বিদ্বেষে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জাতিগত ও ধর্মীয় কিছু কারণ যেকোনো বৃহৎ সংখ্যক মুক্তচিন্তার ইহুদিদের অবাঞ্ছিত করে তোলে। এবং তিনিও তার সময়ের বহু বুদ্ধিজীবীর মতোই গণতন্ত্রকে গভীরভাবে ঘৃণা করতেন।

কবিতাটি প্রকাশের একশ বছর চলছে। সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ, আত্মাহীন পৃথিবীর অনুভূতি, ঐতিহ্য হারানোর দুঃখ, হীনমন্যতা এবং নৈতিক অসাড়তা এ সবই সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে! শুধু আজকের ফেসবুক প্রজন্মের দিকে তাকালেই আমরা তা বুঝতে পারি। হারানো ঐতিহ্যের জন্য আজকের যে অনুসন্ধান তা অবশ্য বিশ্বযুদ্ধের সময়ের থেকে আলাদা। 

এলিয়টের সময়ে, মানুষের হাল-হকিকত সম্পর্কে যে হতাশাবাদ তা মানুষের সম্ভবনাময় ভবিষ্যতের আশাবাদের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। পুরানো শৃঙ্খলার ভাঙ্গন অনেককে বিরক্ত করেছিল, তবে অনেকেই আবার সেই অশান্তি দ্বারা অনুপ্রাণিতও হয়েছিল। গণতন্ত্রের আগমন, নতুন শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল গঠন, উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্থান, নারী অধিকার আন্দোলনের পুনরুত্থান ইত্যাদি নাটকীয় এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল।

সামাজিক ও নৈতিক স্থানচ্যুতিও শিল্প, সাহিত্য এবং সঙ্গীতের অনেক ক্ষেত্রে চমকপ্রদ অগ্রগতি সাধনে সাহায্য করেছে। পিকাসো এবং পপোভা, স্ট্রাভিনস্কি এবং শোয়েনবার্গ, জয়েস এবং উলফ, ল্যাংস্টন হিউজ এবং লুই আর্মস্ট্রং, গ্রোপিয়াস এবং লে কর্বুসিয়ার এবং অবশ্যই ইলিয়ট নিজেও, সেই সময়ে শৈল্পিক অভিব্যক্তিকে পুনর্নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।

আজ আশাবাদের সেই পুরনো ধারা বহুলাংশে দূর হয়ে গেছে এবং সামাজিক রূপান্তরের সম্ভাবনার ওপর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে।

ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, এলিয়ট  "পুরনো কাণ্ডে নতুন কবিতার ফুল" তৈরি করেছেন।
এটি ছিল এলিয়টের শিল্প-নৈপুণ্যের একটি সুন্দরতম উদাহরণ। এটি দুনিয়াজুড়ে সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যাগুলিকেও আলোকপাত করে। সেদিক থেকে (দ্যা ওয়েস্ট ল্যান্ড) এখনও প্রাসঙ্গিক, এখনও আমাদের সাথে কথা বলে, যদিও ইলিয়টের জাদুর মতো নয়; ভিন্ন আঙ্গিকে।

লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম।

 

সর্বশেষ খবর