২২ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৮:১০

স্বেচ্ছায় পাবনা ভ্রমণ

সাদিকুল নিয়োগী পন্নী

স্বেচ্ছায় পাবনা ভ্রমণ

পাবনা মানসিক হাসপাতাল

এক.

বাসায় একটু বিদ্রোহী ভাব দেখাইলে বউ বলে তোমাকে পাবনা পাঠিয়ে দিবো। দশজন পুরুষের মতো আমাকেও চুপচাপ থাকতে হয়। বাপ-চাচাদের দেখে বড় হয়েছি। মানতে অসুবিধা হয় না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে নিজেই উদ্যোগ নিলাম পাবনা বেড়াতে যাবো। দাম্পত্য জীবন থেকে কিছুটা বিরতি নিতে পারলে মন্দ কী! বিষয়টা বাসায় গোপন রাখলাম। বেড়ানোর কথা বলতে গেলে নানা রকম প্রশ্ন করবে।

সহকর্মী পাপ্পুকে দিয়ে ঢাকা টু পাবনা বাসের টিকিট কাটিয়ে রাখলাম। যাওয়ার দিন ঘটিয়ে আসছে। বাসায় বলার সাহস পাচ্ছি না। ভাবলাম হুটহাট ব্যাগ নিয়ে চলে যাবো।
পরিকল্পনামতো একদিন রাতে খাবার খেয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। ব্যাগ গুছিয়ে রুমে দরজা খুলে দেখি বউ দাঁড়ানো। প্রশ্ন করার আগেই আমি বললাম ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। একপলক তার চোখের দিকে তাকানোর পর মনে হলো পুড়ে যাবো, মরে যাবো চোখের আগুনে। আমি দ্রুতপদে রুম থেকে বের হচ্ছি। সে পিছে পিছে দরজা পর্যন্ত আসলো। কানে বাজলো, ‘উড়তেছো বহুত। আমার চোখে কিছু না পড়লেই ভালো। ধরা পড়লে ডানা কাইটা পাবনায় পাঠিয়ে দিবো।’

জোড়া বাংলা মন্দির

 

দুই.
পাবনা শহরে থাকার ব্যবস্থা করা ছিলো আগে থেকেই। ভোরে সেখানে গিয়ে কিছুসময় বিশ্রাম নিলাম। সকাল ৮টার দিকে বের হলাম জেলার দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে। ঢাকা থেকে আসার সময় বাসে একজনের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। তিনি পাবনার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছিলেন। তার পরামর্শ ও ইন্টারনেটের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটা তালিকা করে নিলাম স্বল্প সময়ে কী কী ঘুরে দেখতে পারবো। সকালের ভ্রমণ শুরু করলাম পাবনা মানসিক হাসপাতাল দিয়ে। শহরের বাস টার্মিনাল হতে সাত কিলোমিটার দূরে যেতে হবে আমাদের। ব্যাটারিচালিত একটা রিকশা ভাড়া নিলাম। রিকশা চালককে বললাম হাসপাতালের কাছাকাছি কোনো খাবারের হোটেলের সামনে আমাদের নামাতে। তিনি হাসপাতালে যাওয়ার আগে রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিলেন। হোটেলে নাস্তা সেরে বিল দেওয়ার সময় ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলাম মানসিক হাসপাতালের দূরত্ব সম্পর্কে।

তিনি বললেন মানসিক হাসপাতাল কোনটা? এখানে মেন্টাল হাসপাতাল আছে। পাঁচ মিনিট লাগবে হেঁটে যেতে। হয়তো স্থানীয়দের কাছে হাসপাতালটি এ নামেই পরিচিত। আমি ম্যানজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সহকর্মী পাপ্পুকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার বামপাশে চোখে পড়লো পাবনা মেডিকেল কলেজ। দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস। ইচ্ছে হচ্ছিলো ঘুরে দেখি। পরিচিত কেউ নেই বলে যাওয়ার সাহস করলাম না। যেকোনো ক্যাম্পাসে বহিরাগতের সবাই বাঁকা চোখে দেখে থাকেন। মেডিকেল কলেজের ঠিক বিপরীতেই একটু সামনে মানসিক হাসপাতাল। রোগীদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তার স্বার্থে হাসপাতলের ভেতরে কোনো দর্শনার্থী প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। হাসপাতালের দায়িত্বরত একজনের কাছ থেকে হাসপাতলে রোগী ভর্তির প্রক্রিয়াসহ কিছু তথ্য জেনে নিলাম। বাইরে থেকে হাসপাতালের পরিবেশ দেখে ভালো মনে হলো। আসার আগে মনে হলো বহির্বিভাগ ঘুরে আসি। সেখানে গিয়ে দেখি রোগীদের প্রচণ্ড চাপ। পরিস্থিতি এমন যে কে সুস্থ আর অসুস্থ তা বুঝার উপায় নেই। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে সেখানে গিয়ে মনে হলো। বহির্বিভাগে কয়েকজন যুবককে দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। এমন বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারাতে হয়েছে তাদের।

পাপ্পু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো নতুন গন্তব্যের দিকে রওনা হওয়ার জন্য। হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনেই ব্যাটারিচালিত রিকশা পেয়ে গেলাম। চালককে বললাম জোড় বাংলামন্দির চেনেন কি না?

তিনি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, চিন্তা করার কিছু নাই। রিকশা দিয়ে ঘুরিয়ে যা দেখানোর মতো আমি দেখাবে। তার সাথে ভাড়ার বিষয়ে চুক্তি করে নিলাম। রিকশা চলছে। চালক গাইডের মতো রাস্তার দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও জায়গার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। শুনালেন নানা রকমের গল্পও। একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম জোড় বাংলা মন্দিরের সামনে। জেলা সদরের রাঘবপুর নামক স্থানে অবস্থিত এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম পত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মন্দিরের চারদিক লোহার ফলক দিয়ে সুরক্ষিত। ভেতরে একজন কর্মচারী ফুল গাছের পরিচর্যা করছিলেন। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ফটকের তালা খুলে দিলেন। আমরা মন্দিরে প্রবেশ করলাম। মন্দিরের চারপাশে বিভিন্ন ফুলের গাছ এর সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে। মন্দিরের কোনো শিলালিপি না থাকায় নির্মাতা ও নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। ইটের বেদীর ওপর নির্মিত মন্দিরের সামনের অংশে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। পথের দুই পাশে আছে দুটি বিশাল স্তম্ভ। মন্দিরের দেয়ালের নকশা ও টেরাকোটার বেশ দৃষ্টিনন্দন। মন্দিরের পেছন অংশে মন্দির থেকে বের হবার রাস্তা রয়েছে। আমাদের হাতে সময় কম। কয়েকটা ছবি তুলে আমরা দায়িত্বরত কর্মচারীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। 
চালক এবার আমাদের নিয়ে গেলেন কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালায়। শহরের গোপালপুর নামক স্থানের এই সংগ্রহশালার প্রবেশ পথে রয়েছে নায়িকার বিশাল আকৃতির ছবি সংবলিত সাইনবোর্ড। সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। সংগ্রহশালার সাপ্তাহিক ছুটি। তাই প্রবেশের কোনো সুযোগ হয়নি। বাইরে থেকে দুই চারটা ছবি তুলে বিদায় নিলাম।

চালককে বললাম. হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যাবো। সিএনজি স্টেশনে নিয়ে যেতে। তিনি বললেন, যাওয়ার পথে আমাদের একটা রাজবাড়ি দেখাবেন। আমি বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। আরও অনেক কিছু দেখার বাকি। চালক রকেটের গতিতে আমাদের নিয়ে আসলেন তাড়াশ রাজবাড়িতে। 

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের টানানো সাইনবোডের্র তথ্য মতে, ‘ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার প্রায় ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দেবচাড়িয়া গ্রামের বাসুদেব ওরফে নারায়ণদেব চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি নবাব ইসলাম খাঁর অধীনে চাকরি করতেন। নবাব তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে এই জায়গাটি তাকে দান করেন। তৎকালে ‘পরগনা কাটার মহল্লা’ হতে দুইশত মৌজা নিয়ে এই চৌধুরী তাড়াশ জমিদারী সৃষ্টি হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নারয়ণদেব চৌধুরীর বংশধর বনমালী রায়কে জনহিতকর কাজ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর উপাদি প্রদান করেন। তিনিই পাবনা জেলার সদর উপজেলার গোপালপুর মৌজায় তাড়াশ ভবনটি নির্মাণ করেন। জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে নান্দনিক সৌন্দর্য আর স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন এটি। এ ভবনটি তাড়াশের রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। বিট্রিশ শাসনামলে ইন্দো-ইউরোপীয় রীতিতে নির্মিত জমিদার বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে ‘রায়বাহাদুরের প্রতীক’ হয়ে। ১৮‘শ শতকের কোনো একসময় তাড়াশ রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন  তৎকালীন জমিদার বনমালী রায়। পূর্বমুখী দ্বিতল ভবনটি চারটি রোমান করিনথিয় স্তম্ভের ওপরে আকর্ষণীয় দ্বিতল গাড়ি বারান্দা প্রাচীন কীর্তির সাক্ষ্য বহন করে। নির্মিত প্রাসাদের চারদিকে সীমানা প্রাচীর এবং সন্মুখের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের শেষপ্রান্তে প্রধান প্রবেশ ফটক। ফটকের দুই পাশে দুটি করে চারটি স্তম্ভ এবং নরমান থামের শিরাবরকের মাঝথখানে বিশাল আকৃতির অর্ধবৃত্তাকার খিলান রয়েছে। এই প্রবেশ পথ হতে মূল ভবনটি ৩৫ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত।

অপরূপ কারুকাজে নির্মিত বাড়িটির নিচতলায় ৮টি কক্ষ এবং দ্বিতীয় তলায় ৮টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে নিচতলার কেন্দ্রেীয় কক্ষটির ছাদে পিতলের পাতে বিশেষভাবে জ্যামিতিক বর্গ এবং ফুলের নকশা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভবনটির ছাদ লোহার বিম ও বর্গার ওপর টালি দ্বারা নির্মিত। প্রাচীন এই ভবনটির ৮০টি দরজা ও ৫৩টি জানালা রয়েছে। নিচতলা থেকে ওপরে উঠার জন্য ভবনের উত্তরদিকে একটি কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। বর্তমানে তাড়াশ ভবন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।’
 স্বপ্নদ্বীপ
 

তিন.
চোখ জোড়ানো তাড়াশ রাজবাড়ি ঘুরে রিকশা চালককে বললাম সিএনজি স্ট্যান্ডে নিয়ে যেতে। তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্ট্যান্ডে যাওয়ার পর বৃষ্টির তীব্রতা বাড়লো। রিকশা চালকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সিএনজি ভাড়া করলাম। এই চালকও বেশ ভালো। তিনি আরও কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বললেন। পাকা রাস্তার দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে। চালক সিএনজি থামিয়ে বললেন, এখান থেকে দেখতে হবে। আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। দূর থেকে এর সৌন্দর্য বুঝার তেমন উপায় নেই। চালক বিষয়টি বুঝতে পেরে বললেন, ব্রিজের কাছাকাছি যেতে হলে পাকশি রেলওয়ে স্টেশনে যেতে হবে। আমি বললাম সেখানেই চলেন। সিএনজি গিয়ে থামলো রেলস্টেশনের সামনে। বেশ পুরাতন স্টেশন। এটিও দেখার মতো। চালকসহ তিনজন স্টেশনের পাশের একটা টং দোকানে চা খেলাম। স্টেশনের কম্পার্টমেন্ট সমতলভূমি থেকে কিছুটা উপরে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে সেখানে গিয়ে আরও কিছু দর্শনার্থীর দেখা পেলাম। রেললাইনের পাশ দিয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত যাওয়া যায়। নিরাপত্তাজনিত কারণে হেঁটে ব্রিজে যাওয়ার অনুমতি নেই। দূর থেকে যতটুকু সম্ভব তা দেখেই মুগ্ধ হলাম। 

ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন রেলসেতুটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসেতু হিসেবে পরিচিত। এই সেতুর নির্মাণকাল ১৯০৯-১৯১৫। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নাম অনুসারে এই সেতুর নামকরণ করা হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১,৭৯৮.৩২ মিটার বা ৫৯০০ফুট। এর ওপর দু’টি ব্রড-গেজ রেললাইন রয়েছে। ১৮৮৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ভারত সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সাথে কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব করেন। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি লাভের পর বৃটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস সেতু নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯০৯ সালে ব্রিজ নির্মাণের সার্ভে শুরু হয়। ১৯১০-১১ সালে পদ্মার দুই তীরে ব্রিজ রক্ষার বাঁধ নির্মাণ হয়। ১৯১২ সালে ব্রিজটির গাইড ব্যাংক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পাশাপাশি শুরু হয় ব্রিজটির গার্ডার নির্মাণের কাজ। তারপর ব্রিজটির গার্ডার নির্মাণের জন্য কূপ খনন করা হয়। ২৪ হাজার শ্রমিক দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৫ সালে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। সেতুটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১ শত ৬৪ টাকা। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮ শত ফুট। ব্রিজটিতে ১৫টি স্প্যান আছে। তৎকালীন সময়ে এ ধরনের স্থাপনার মধ্যে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজই ছিল সবচেয়ে গভীরতম স্থাপনা।’

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশেই নির্মিত হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লালন শাহ সেতু। ফেরার পথে একনজর দেখা হলো সেতুটি। পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কেন্দ্রিক পদ্মার চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে ঘিরে বিভিন্ন রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট গড়ে তোলা হয়েছে।

পাকশি রিসোর্ট

 

চার.
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশ দিয়ে দুইবার আসা-যাওয়া করলাম। খুব ইচ্ছে ছিলো ঘুরে দেখার। ক্যাম্পাসের এক ছোট বোন সেখানে চাকরি করেন। আগে থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। হঠাৎ ফোন করে বিড়ম্বনা বাড়াতে চাইনি। চলতি পথে দেখতে হলো বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
চালককে বললাম, ফেরার সময় হয়েছে আর কিছু দেখাবেন নাকি?
উনি বললেন, পাকশি রিসোর্টে ঘুরতে পারেন।
হাতে তখনও সময় আছে। বিকালে তাঁতশিল্প দেখে যাবো পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফাহাদ ভাই সেখানে শিক্ষকতা করেন। পাকশি রিসোর্টে ভেতরের পরিবেশটা বেশ সুন্দর। সবুজ গাছ দিয়ে দুই পাশ সাজানো। লাল টি শার্ট পরে দুই পাশে সবুজ গাছের সারির মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে আমি ছবি তুলছি। হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। এখানে পরিচিত কেউ থাকার কথা না। এগিয়ে গিয়ে দেখি পাবনায় আসার সময় যে লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিলো তিনি একজনকে নিয়ে লেকের পাশের সিঁড়িতে বসা। আমি বিব্রতকর অবস্থায় পরে গেলাম। স্বল্পবাক্যে তার সাথে কথা শেষ করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
 রিসোর্টটি বেশ পরিপাটি, সাজানো-গোছানো। চারদিকে ফুল ও নানা রকমের গাছের সারি পার হয়ে গেলাম কটেজের রিসিভশনে। উনার দেওয়া তথ্যমত্যে সুইমিং পুলসহ আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা রিসোর্টে রয়েছে। নিরিবিলি পরিবেশে রাত্রীযাপন করতে চাইলে এখানে থাকা যেতে পারে। রিসোর্টের মিনি চিড়িয়াখানা দেখে বের হয়ে আসলাম। 

দুপুরে খাওয়া হয়নি। কিছুটা ক্লান্তিবোধ হচ্ছিলো। চালককে বললাম ফেরার পথে কোথাও হোটেল পেলে থামার জন্য। চালক বললেন, স্বপ্নদ্বীপ একনজর দেখে যান।
চালক স্বপ্নদ্বীপের গেটে সিএসজি থামিয়ে বললেন, আপনারা ঘুরে আসেন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আমি পাপ্পু টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম। বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তুলা হয়েছে এই রিসোর্ট। স্বপ্নের মতো চোখ জুড়ানো রিসোর্টের সৌন্দর্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও বাহারি রঙের গাছ রোপণ করা আছে। রয়েছে বিভিন্ন ধরেনর ভাস্কর্য। বলতে গেলে অবসর কাটানোর সকল ধরনের আয়োজন নিয়েই গড়ে উঠেছে স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্ট। প্রাকৃতিক পরিবেশে রাত্রিযাপনের সুব্যবস্থা।
 পাবনার জালালপুরের তাঁতশিল্প


পাঁচ.
ঈশ্বরদী থেকে ফেরার পালা। সিএনজি চলছে পাবনা শহরের দিকে। চলার পথে খাবারের হোটেল খুঁজছিলাম। কয়েক কিলোমিটার আসার পর রাস্তার পাশে একটা খাবারের দোকান চোখে পড়লো। স্বামী-স্ত্রী দুইজনে মিলে এটি পরিচালনা করেন। ঘরোয়া পরিবেশে চালকসহ খাবার খেয়ে নিলোম।
চালককে বললাম আমি, পাবনার তাঁতশিল্প এলাকা ঘুরে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে যাবো। সেখানে ঘনিষ্ট বড় ভাই শিক্ষকতা করেন। 
চালক বললেন, ওই রুটে তার সিএনজি চালানোর অনুমতি নেই। তবে তিনি আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন।
বিকালের দিকে সিএনজি চালক জেলা শহরের মোড়ে তার গন্তব্যের সমাপ্তি ঘটালেন। তিনি নিজে আমাদের জন্য ব্যাটারিচালিত একটা রিকশা ঠিক করে দিলেন। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পার হওয়ার কিছুদূর পরই দেখতে পেলাম রাস্তার দুই পাশে রঙিন সুঁতা শুকাতে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকরা কাপড় বুননে ব্যস্ত। পাবনা সদরের জালালপুর এলাকার একটা কারখানায় অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলাম। নিজ চোখে দেখার সুযোগ হলো রঙিন সুঁতায় স্বপ্ন বুননের দৃশ্য। এখানের কারখানাগুলোতে মূলত লুঙ্গি তৈরি করা হয়। সেগুলো বিক্রি করা হয় পাইকারি দামে। ঘুরেফিরে দেখা শেষ হলে রিকশা চালক আমাদের পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসলেন। চালককে ভাড়া দিয়ে বিদায় দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের সামনে থেকে ফাহাদ ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি মাঠে সহকর্মীদের সাথে ফুটবল খেলছিলেন। দীর্ঘদিন পর ভাইয়ের সাথে দেখা। কুশল বিনিময়, ফটোসেশন শেষে তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখালেন। ক্যাম্পাস ছোট হলেও বেশ পরিপাটি ও গোছানো। বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষক বেশি। দেখে বুঝার উপায় নেই কে শিক্ষক কে শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনেকটা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। সবশেষে সন্ধ্যায় ফাহাদ ভাই ও তার সহকর্মীদের সাথে আসলাম শহরে। সবাই মিলে শহরের একটি মিষ্টান্নের দোকানে মালই চপসহ অন্যান্য মিষ্টি খেলাম। এমন খাওয়া-দাওয়ার পর একটা আড্ডা প্রয়োজন। ভাইকে বলার পর তিনি তার একসহকর্মীসহ আমাদের নিয়ে গেলেন উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের মাঠে।

এটি অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের পাবনা জেলার একটি ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৯৮ সালে শ্রী গোপালচন্দ্র লাহিড়ী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ছায়াঘেরা সুবিশাল ক্যাম্পাসের সন্ধ্যার পর সকল শ্রেণিপেশার মানুষের আড্ডায় বেশ জমজমাট মনে হলো। আমাদের ফিরতে হবে। ফাহাদ ভাই ও তার সহকর্মীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমের দিকে রওনা হলাম। পথে এক পলক দেখে নিলাম রূপকথা সিনেমা হল। সিনেমা হলের সামনের সম্ভু সরকার নামে একজন দোকনাদারের সাথে পরিচয় হলো। প্রায় বিশ ত্রিশ বছর ধরে তিনি এ এলাকায় ব্যবসা করেন। তার দেওয়া তথ্য মতে এখনও ভালো সিনেমা চললে হলে প্রচুর দর্শক আসেন। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে আমাদের ঢাকায় ফেরার সময় হয়েছে। সময় থাকলে সিনেমা দেখার ইচ্ছে ছিলো। তবে দুই তিন রাত বাইরে থাকার কারণে বাসায় সিনেমা অপেক্ষা করছে এটা নিশ্চিত। পাবনা শহরকে বিদায় জানিয়ে রাতের বাসে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে।

যেভাবে যাবেন: রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি পাবনায় যেতে বিভিন্ন পরিবহনের বাস রয়েছে। এছাড়া দেশে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা থেকে পাবনা শহরে বাসে আসতে পারবেন। শহর থেকেই দর্শনীয় স্থান ঘুরে ফিরে দেখতে পারবেন। 

কোথায় থাকবেন: পাবনা শহরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন রেস্ট হাউজ ও হোটেল রয়েছে। আপনার বাজেট অনুযায়ী নির্বিগ্নে সেখানে থাকতে পারবেন।

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর