শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রনাথ জীবনসায়াহ্নের দিনগুলি

হাসান হাফিজ

রবীন্দ্রনাথ জীবনসায়াহ্নের দিনগুলি

বাংলা সাহিত্যের মহত্তম প্রতিভা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি কেমন ছিল? জানার কৌতূহল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কবির শেষ অসুস্থতার সময়ে যে কয়েকজন স্বজন-শুভার্থী তাঁর সেবা-শুশ্রƒষা করতেন, সুধাকান্ত তাদের অন্যতম। তিনি লিখেছেন, “রোগের নিদারুণ যন্ত্রণায় রোগী কাতরতা প্রকাশ করে এইটেই স্বাভাবিক নিয়ম, কিন্তু...রোগকাতর রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে আমরা যা লক্ষ্য করলুম, তা সাধারণ নিয়মের বহির্ভূত ব্যাপার। যন্ত্রণাকে অবিচলিতভাবে সহ্য করার অসাধারণত্ব দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। যাঁরা তাঁর সেবা-শুশ্রুষায় নিযুক্ত থাকেন তাঁদের চিত্তবিনোদন করেন তিনি নানারকম হাস্য-পরিহাস দিয়ে, নিজের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করবার উপায়ও হয়তো তাই। বিমর্ষতার চর্চা করা রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবিরুদ্ধ।”

মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারতের প্রতি এক বিদেশিনীর অপমানকর উক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মিস ই. রাথবোন নামের এক ইংরেজ মহিলা ছিলেন ব্রিটিশ বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পার্লামেন্টের সদস্য। তিনি ভারতের নিন্দা করে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। রোগশীর্ণ শরীরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘খোলা চিঠি’ লিখেই তার সেই আপত্তিকর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। কবির মন্তব্য এসোসিয়েটেড প্রেসের মাধ্যমে ভারতের সব ইংরেজি দৈনিকে ছাপা হলো। কবি তাতে বলেন, “ভারতীয়দিগকে লিখিত মিস রাথবোনের খোলা চিঠি পড়িয়া আমি গভীর বেদনা অনুভব করিয়াছি।... তাঁহার এই পত্র প্রধানত জওহরলালের উদ্দেশ্যেই লিখিত এবং একথা আমি নিঃসন্দেহে বলিতে পারি, মিস রাথবোনের দেশবাসীগণ আজ যদি ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের এই মহানুভব যোদ্ধার কণ্ঠ কারাপ্রাচীরের অন্তরালে রুদ্ধ না রাখিত, তাহা হইলে তিনি মিসের এই অযাচিত উপদেশের যথাযোগ্য ও সতেজ উত্তর দিতেন। বল প্রয়োগজনিত তাঁহার মৌন আমাকেই, রোগশয্যা হইতেও এই প্রতিবাদ জানাইতে বাধ্য করিয়াছে।”

কী ছিল তাঁর পীড়া কিংবা ব্যাধি? এনলার্জড প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের গুরুতর সমস্যা ছিল। ‘টেগোর’স লাস্ট ডেজ: দ্য লিটল প্রোস্টেট এন্ডস আ বিগ লিজেন্ড’ শিরোনামের এক রচনায় ডা. অমিত ঘোষ বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন কবির কিডনিতেও সমস্যা ছিল। আরও ছিল জ্বর, মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা, খাওয়া-দাওয়ায় অনাগ্রহ। শল্য চিকিৎসায় কবির অনুমোদন ছিল না, শেষ অবধি তাই করতে হয়। পীড়িত কবির সুস্থতার জন্যে যত্ন আত্তি সেবা পরিচর্যা শুশ্রƒষা নিতান্ত কম হয়নি।

কবির মৃত্যুচিন্তা কেমন ছিল? নির্মলকুমারী মহলানবিশকে তিনি প্রায়ই বলতেন, “মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনো মানে নেই। আর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে জীবনকে না দেখলে অমৃতের সন্ধান মেলে না। এই জীবন মরণের খেলা দিয়েই জগৎ সত্য হয়ে উঠেছে।” পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের মর্মান্তিক মৃত্যুশোক অনেকবারই সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। দৃপ্তকণ্ঠে তাঁর পক্ষেই বলা সম্ভব ‘করি না ভয় তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া, দাঁড়াবো আসি তব অমৃত দুয়ারে।’ জীবনের শেষ প্রান্তে নিজের হাতে লিখতে পারতেন না। আপন অসুস্থতার কথা বিশেষ বলতে চাইতেন না। নিজ হাতে লিখতে গেলে হাত কাঁপত। পেশি শিথিল হয়ে যেত। তখন মুখে মুখে বলে যেতেন। লিপিকার সুধীরচন্দ্র কর লিখে নিতেন। তিন সঙ্গী বইয়ে ‘রবিবার’ নামে যে গল্পটি অছে, সেটিই প্রথম মুখে বলে লেখানো। রোগশয্যায় তাঁর পাশে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের সঙ্গে হাসি-তামাশা করতে ভালোবাসতেন রুগ্ন মানুষটি। সেবাদানকারীদের কষ্ট কমানোর জন্য, নিজের শারীরিক ক্লেশ ও যন্ত্রণা হ্রাসের জন্য নানা রকমের মজাদার ছড়া শোনাতেন সবাইকে। উদ্দেশ্য, গুরুগম্ভীর উৎকণ্ঠার ভারি, অস্বস্তিকর পরিবেশ একটুখানি হালকা করার চেষ্টা। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর সেবারতা পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ‘ডাবও ভালো ঘোলও ভালো/ভালো সজনে ডাঁটা,/বৌমা বলেন ভালো নহে? শুধু সিঙ্গি মাছের কাঁটা’। নাতনির জন্যে মুখে মুখে বলা ছড়াটি হচ্ছে ‘ঘড়ি ধরা নিদ্রা আমার? নিয়ম ঘেরা জাগা/একটুকু তার সীমার পারেই? আছে তোমার রাগা।/ কি কব আর রবিঠাকুর/ ভয়ে তরস্ত/এত বড় মানুষ ছোট্ট? ঘাতের করস্ত।’ বয়সী কবির শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি গৃহবন্দী। নিতান্ত নিরুপায়। যখন ঘুমোন, উদ্বিগ্ন আত্মীয়-স্বজনরা ত্রস্ত চোখে দূর থেকে দেখে তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক নিয়মে চলছে কি না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশিরভাগ সময় সোফায় বসে থাকেন। আচ্ছন্নের মতো। একদিন রাত বারোটার পর তন্দ্রা ভেঙে গেল। ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলেন, দারোয়ানের যেন পেটে ব্যথা হয়েছিল। সে আছে কেমন? কোনোদিন বা কুকুরটাকে খাবার দিয়ে আদর করেন। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকেন চড়ুইয়ের দিকে। মৃত্যুভয়ে ভীত নন কবি। একদিন তাঁকে বলা হলো, আচ্ছা বুড়ো বয়সে সক্কলেই ঠাকুরদেবতার নাম জপে, আর আপনি কিনা পশুপাখি লোকজন নিয়ে হাসি গল্প করছেন। লোকে আপনাকে কী বলবে? একথা শুনে কবি বেশ মজা পান। কৃত্রিমভাবে গম্ভীর হয়ে বলেন, সত্যিই তো। লোকে কী বলবে?

মৃত্যুর কিছু সময় আগে কবির শরীর যখন বেশ খারাপের দিকে, কোনো চিকিৎসায় কোনো উপকার পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তিনি অবস্থান করছিলেন শান্তিনিকেতনে। কলকাতা থেকে এলেন ডাক্তার ইন্দুভূষণ বসু, বিধানচন্দ্র রায়, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পারিবারিক বন্ধু জ্যোতিপ্রকাশ সরকার। তারা কবিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। স্থির হলো- শ্রাবণ মাসে অপারেশন করা হবে। ডাক্তার রামচন্দ্র অধিকারী, জিতেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ বিশেষজ্ঞও চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। তারা সবাই অপারেশন করার ব্যাপারে একমত।

রবীন্দ্রনাথকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই (৯ শ্রাবণ)। কবির জন্য বিশেষ একটি সেলুন গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন সেই সময়কার  ইআই রেলওয়ের কর্মকর্তা এনসি ঘোষ। দীর্ঘ ৭০ বছরের সম্পর্ক শান্তিনিকেতনের সঙ্গে। বাল্য, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, জীবনের নানা পর্যায়েই এখানে কবির স্মৃতি জড়ানো। সায়াহ্নের দিনগুলো সমাগতপ্রায়। ফিরলেন জোড়াসাঁকোর পৈতৃক বাড়িতে। বুঝতে পারছেন, ফুরিয়ে আসছে আয়ু। কলকাতায় ফেরার দুই দিন পরে লিখলেন,

প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে-

কে তুমি।

মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-

কে তুমি।

পেল না উত্তর।

কবির শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে আসছে। রোগশয্যায় ঠিকমতো পা নাড়াচাড়া করতে পারেন না। বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলে সবাই। নাতনি তাঁকে ঘুম পাড়াতে চায় ওষুধ খাইয়ে। সবার অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে তিনি কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করেন। দেখা গেল রাত ৩টার সময় অভ্যেসমাফিক কিছু একটা লিখতে চান। সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে, না না। এখনো ওঠার সময় হয় নি। কবি অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোরা আমাকে ফাঁকি দিচ্ছিস।’ অশক্ত শরীরে একটানা কাজ করা সম্ভব হয় না। দৃষ্টি ক্ষীণ। কপালের শিরায় শীর্ণতা ফুটে ওঠে তাঁর। শ্রবণশক্তির অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। কবির মনে প্রশান্তি দেওয়ার জন্য দু’তিন জন মেয়ে পালা করে তাঁর ফরমায়েশি গানগুলো গেয়ে শোনায়। শুনে তিনি বলেন, “ওরে, গানটা ভালো করে গা’ তো। সিন্ধুপারে চাঁদ তো বুঝি আমার জন্য আর উঠবে না।”

যখন শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় আসছিলেন, তখন চোখে পড়েছিল ভুবনডাঙার রাস্তার ধারের নতুন পাওয়ার হাউস। সেটা দেখে নাতনি নন্দিতাকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “পুরনো আলো চললো, আসবে বুঝি এবার তোদের নতুন আলো”। কবির ধারণা ছিল, চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে আবার ফিরে যেতে পারবেন প্রিয় ঠাঁই শান্তিনিকেতনে। ‘উদয়ন’ নামের বাড়ির দোতলা থেকে নিচে নামার পর তাঁর প্রিয় ‘বাঙাল’ ক্ষিতিমোহন সেনকে বলেছিলেন, “এক মাস পর ফিরবো। দেখো ছড়ার বইটা যেন ছাপানো শেষ হয়ে থাকে।”

কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির সার্বক্ষণিক দেখভাল, সেবা শুশ্রƒষা করেন প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী নির্মলকুমারী মহলানবিশ। এই ভদ্রমহিলার ডাকনাম ছিল রানী। কবি কৌতুক করে তাকে ‘হেডনার্স’ বলে ডাকতেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ নামের বইয়ে কবি জীবনের একেবারে শেষ দিনগুলোর কথা লিখে গেছেন তিনি। যদি কখনো শ্রীমতী নির্মলকুমারী মহলানবিশের কোথাও যাওয়ার কথা ওঠে, কবি তখন হুমকি দেন। কী সেই হুমকি? বলেন, “শেষ পর্যন্ত এমন একটা অসুখ করবো, তখন দেখি আমার হেডনার্স কি করে যায়।”

অপারেশন জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই করা হবে বলে সাব্যস্ত হয়। সে উপলক্ষে বাড়ি ঘরদোর সাফসুতরো পরিষ্কার করা হয়েছে। ডাক্তার সত্যেন্দ্রনাথ রায় গ্লুকোজ ইনজেকশন দিলেন কবিকে। জ্বর এলো ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপুনি দিয়ে। পরের দিন। ইনজেকশনের প্রভাব কেটে যাওয়ার পর বেশ হাসিমুখে কবি বলেন রানী মহলানবিশকে- “জানো আজও একটা কবিতা হয়েছে সকালে। এ কী পাগলামি বলো তো? প্রত্যেকবারই ভাবি এই বুঝি শেষ, কিন্তু তারপরেই দেখি আবার একটা বেরোয়। এ লোকটাকে নিয়ে কি করা যাবে?” কবির ওই লেখাটি ছিল ‘প্রথম দিনের সূর্য’ নামের বিখ্যাত সেই কবিতা। গভীর যন্ত্রণা, অবসন্নতা, ক্লান্তি ও কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে কবিকে। এই মহা দুঃসময়েও তাঁর প্রতিভা যেন আরও প্রকাশোন্মুখ, আরও দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে। কবি সে সময়ে বলেছিলেন, “জীবনের গভীর দুঃখের সময়ই দেখি লেখা আপনি সহজে আসে। মন বোধহয় নিজের রচনা শক্তির ভিতরে ছুটি পেতে চায়।”

একমাত্র নাতি নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ আসার পর অনেকে পূর্বনির্ধারিত ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠান বাতিল করার কথা বলেছিলেন। কবি এ প্রস্তাবে সম্মত হন নি। এ সম্পর্কে মেয়ে মীরাকে তিনি লিখেছিলেন, “নিতুকে খুব ভালোবাসতুম, তাছাড়া তোর কথা ভেবে প্রচ- দুঃখ চেপে বসেছিল বুকের মধ্যে। কিন্তু সর্বলোকের সামনে নিজের গভীরতম দুঃখকে ক্ষুদ্র করতে লজ্জা করে। ক্ষুদ্র হয় যখন সেই শোক সহজ জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।”

কবে অপারেশন করা হবে, সেই দিন তারিখ কবিকে আগেভাগে জানানো হয়নি। গোপন রাখা হয়েছিল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুলাই রচনা করেন জীবনের শেষ কবিতাটি। রানী চন্দের কলমে সেটি লিখিত হয়। ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী।’ সকাল সাড়ে ন’টায় শেষ তিনটি লাইন কবি লিখে নিতে বলেছিলেন রানী চন্দকে। বলেছিলেন, সকালবেলার কবিতাটার সঙ্গে জুড়ে দিস। তারপর জানলেন অপারেশনের কথা। সকালের কবিতাটা রানীকে পড়ে শোনাতে বললেন। রানী চন্দ কবির কানের কাছে গিয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করলেন সেই কবিতা। শুনে বললেন কবি, “কিছু গোলমাল আছে। তা থাক। ডাক্তাররা তো বলেছে, অপারেশনের পর মাথাটা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভালো হয়ে ওটা পরে মেজে ঘষে দেবো।”

অস্ত্রোপচার হয়ে গেল। তার পর দেখা দিল প্রস্রাবের সমস্যা। খুবই ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত শরীর কবির। নির্মলকুমারীর উদ্বিগ্ন শঙ্কাতুর মুখ দেখে হাঃ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন কবি। শ্রীমতী মহলানবিশ হাসি চেপে রাখতে পারেন না। তক্ষুণি বলে ওঠেন কবি, এই তো একটু হাসো। তা না মুখ গম্ভীর করে এসে দাঁড়ালেন। এত গম্ভীর কেন? এ সময় ঘন ঘন হিক্কা উঠতে থাকে রবীন্দ্রনাথের। নাস্তানাবুদ হাল। দেশীয় টোটকা মিছরি, এলাচগুঁড়ো দেওয়া হলো বারকয়েক। বিপর্যস্ত অবস্থা কিছুটা কেটে যায় এতে। কবি মন্তব্য করেন, “আঃ বাঁচলুম। এই জন্যই তো হেডনার্স বলি।”

অবশেষে ঘনিয়ে এলো চরম সময়। মৃত্যুর দিন। ২২ শ্রাবণ। ৭ আগস্ট ১৯৪১। সেদিন ছিল রাখীপূর্ণিমা। কবির মুখ পুব দিকে রাখা হয়েছে। রবি আজ অস্তাচলে যাবেন। আগের রাতে চীনা ভবনের অধ্যাপককে কবির খাটের পাশে অ্যাম্বারের জপমালা নিয়ে জপ করতে দেখার পর থেকেই ভগবানের নাম ধ্বনিত হয় সেই ঘরে। কবির কানের কাছে গিয়ে অমিতা দেবী পড়লেন ‘শান্তম শিবম অদ্বৈতম’ মন্ত্র। আর, বিধুশেখর শাস্ত্রী কবির পায়ের কাছে বসে শুরু করলেন ‘ওঁ পিতা নোহসি’ মন্ত্রপাঠ। ব্রহ্মসংগীত গাওয়া শুরু হয় শেষ রাত থেকে। মধ্যাহ্নের ঠিক শেষ মুহূর্ত। কবির ডান হাতটি কাঁপতে কাঁপতে উপরে উঠে কপালে ঠেকাতেই পড়ে গেল। সব শেষ। বর্ণিল রবীন্দ্রজীবনের অবসান ঘটলো এই সঙ্গে। বেলা তখন ১২টা বেজে ১০ মিনিট।

মৃত্যুর পর কী হবে? কবির ইচ্ছা ছিল, কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে ‘জয় বিশ্বকবি কি জয়, বন্দে মাতরম’ ইত্যাকার জয়ধ্বনির মধ্যে যেন তাঁর অন্তিমযাত্রা না হয়। তাঁর আকাক্সক্ষা ছিল শান্তিনিকেতনের উদার মাঠে উন্মুক্ত আকাশের তলায় স্তব্ধ প্রকৃতির সঙ্গে যেন মিশে যেতে পারেন। সেই আকাক্সক্ষা তাঁর পূরণ হতে পারল না। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন শোকে মুহ্যমান। প্রশান্ত মহলানবিশ গুরুতর অসুস্থ। শয্যাশায়ী। এঁরা পারতেন কবির সেই ইচ্ছা পূরণ করতে।

শান্তিনিকেতনের ছাত্র প্রদ্যোৎকুমার সেনও জনতাকে রাজি করাতে পারেন নি। সবার বক্তব্য: শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সব আয়োজন করা হয়ে গেছে এখানেই। বিকাল ৩টার দিকে একদল লোক বরবেশী কবিকে তুলে নিয়ে গেল। সেই মিছিলে যথারীতি ধ্বনিত হলো- “জয় বিশ্বকবির জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দে মাতরম।”

সর্বশেষ খবর