শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব ১

ঠিকানা

হাসনাত আবদুল হাই

ঠিকানা

তিনি কখনো ধীরে, কখনো দ্রুতগতিতে হাঁটছেন, ইচ্ছা করে নয়, নিজের অজান্তেই, যেন কেউ অদৃশ্যে থেকে তাঁকে ওইভাবে হাঁটতে বলছে। এমন তাঁর প্রায় অনেক সময় হয়, বলা যায় অনেক দিনের অভ্যাস। এখন বিকাল, যারা অফিসে কাজ করে তাঁরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় আর সরকারি অফিসের উঁচু দালানগুলো নানা সাইজের, মুখের আর পোশাকের মানুষ উগরে দিতে শুরু করেছে। রাস্তায় এখন মানুষ, বাস, গাড়ি আর সিএনজির ঢল নেমেছে। মানুষ আর যানবাহনের মিলিত স্বরে কোলাহল গমগম করছে চারিধার, যেন ঝড়ো বাতাস ছুটে এসেছে চারিদিক থেকে। এতে তার কিছু অসুবিধা হয় না, ট্যাপ খুললে পানি পড়ার মতো এই শব্দও তাঁর পরিচিত। এই সময় শব্দগুলো খুব মানায়, যেমন বৈশাখের প্রথমে কালবৈশাখীর ঝড়।

খোরশেদ আলমের বয়স ষাটের কিছু ওপর। তিনি আজকাল হিসাব করেন না, ভাবেন, কী হবে হিসাব করে? কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর হলো। তারপর থেকে সপ্তাহের দিন গোনা, দিনগুলোর নাম মনে রাখা, এইসব আস্তে আস্তে ভুলে গিয়েছেন তিনি। বলা যায়, অবসরের দিনগুলো সংজ্ঞাহীন, নামহীন হয়ে পড়েছে অনভ্যাসে। হোয়াই আর দেজ নাম্বার্ড অ্যান্ড নট লেটার্ড কে যেন বলেছিলেন। ভুল। কারও কারও জীবন হয়ে যেতে পারে সংজ্ঞাহীন, নামহীন, দুটোই।

বিকালে ফুটপাত ধরে হাঁটছেন খোরশেদ আলম। যেতে যেতে তীক্ষè চোখে দেখছেন। তাঁর ডান হাতে মোবাইল ধরে রাখা। আইএমএ ক্যামেরা, কে বলেছিল এই কথা কোন বইতে? তিনি অতীত স্মৃতি ঘাঁটেন। এককালে খুব বিদেশি বই পড়েছেন, চাকরিতে ঢোকার পর সেই অভ্যাসে ছেদ পড়েছে।  অবসরের এই সময় আবার ফিরে যাবেন ছাত্রজীবনের সেই অভ্যাসে, ভাবেন খোরশেদ আলম। কিন্তু এক নদীর এক স্রোতে দুবার পা দেওয়া যায় না, এ কথাও তো পড়েছেন তিনি...
বিকালে হাঁটার সময় খোরশেদ আলমের হাতে মোবাইল থাকে। না কেউ তাঁকে ফোন করতে পারে, এটা ভেবে নয়। হঠাৎ মনে পড়লে তিনি কাউকে ফোন করবেন, সে জন্যও নয়। তিনি মোবাইল হাতে রাখেন ছবি তোলার জন্য। অবসরের পর এই একটা হবি হয়ে গিয়েছে, শখের নেশা। তার আর অন্য কোনো হবি নেই, নেশাও না। তিনি ধূমপান করেন না, মদ খান না, খুবই সাদামাটা ধরনের মানুষ। শুধু মোবাইলে ছবি তোলার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে কিছুদিন থেকে, তাও সব সময় আর সব জায়গায় না। তিনি ছবি তোলেন রাস্তায়। কীসের বা কার ছবি তোলেন? কেউ তাঁকে এই প্রশ্ন করেনি এখনো। করলে তিনি একটা লাজুক হাসি হাসবেন, ধরা পড়ে যাবার হাসি। শুধু ওইটুকু, এর বেশি কিছু বলবেন না, আকারে কিংবা ইঙ্গিতে। তিনি ছবি তোলেন রাস্তায় যেসব ইন্টারেস্টিং দৃশ্য দেখেন, সেসব। তার মধ্যে মানুষ আছে, যানবাহন আছে, ফুটপাতে সাজিয়ে রাখা পসরা আছে, আরও কত কী! রাস্তা একটা ক্যালিডোস্কোপ, ছবির মিছিল সেখানে। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই চোখে পড়ে, জেনেছেন খোরশেদ আলম ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে। বুঝতে পেরেছেন এই আবিষ্কার বই পড়ে হয় না, হয় অভিজ্ঞতা থেকে। তাই এখন তাঁকে বলতে হয় না কখন মোবাইলের ক্যামেরা তাক করে ঝট করে তুলে ফেলতে হবে ছবিটা সাবজেক্ট জেনে ফেলার আগেই, বিশেষ করে সাবজেক্ট যদি হয় মানুষ, তা সে গরিব হোক কিংবা ধনী।

মজার ব্যাপার হলো- খোরশেদ আলম মোবাইল ব্যবহার করতে শুরু করেছেন অবসরে যাওয়ার পর থেকে। তাঁর পুত্রবধূ জোর করে নকিয়া কোম্পানির একটা মোবাইল সেট কিনে দিয়ে বলল, বাবা এটা রাখুন। অফিস থেকে দেওয়া টেলিফোন নিয়ে গেলে কোনো অসুবিধা হবে না যোগাযোগ করতে এটা দিয়ে।

খোরশেদ আলম সেটা হাতে নিয়ে বলেছিলেন, মা, এটা কি আমি হ্যান্ডল করতে পারব। বউমা হেসে বলেছিল, খুব পারবেন। আজকাল সবার হাতে মোবাইল সেট। আমাদের বুয়ারও আছে। শুনে অবাক হয়েছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে বলেছিলেন, বুয়া? পুত্রবধূ আবার হেসে বলেছিল, জি। অনেক দিন থেকেই সে ওটা ব্যবহার করে গ্রামের বাড়িতে সবার সঙ্গে কথা বলে। তারপর একটু থেমে বলেছিল, অনেক রিকশাওয়ালাও ব্যবহার করে। দেখেননি?

না খোরশেদ আলম দেখেননি। এত দিন অফিসের গাড়িতে যাওয়া-আসা করেছেন। তাই রিকশাওয়ালাদের হাতে মোবাইল আছে কি নেই লক্ষ্য করেননি। পুত্রবধূর কাছে শুনে একটু লজ্জিত হলেন। আমতা আমতা করে মোবাইল সেট নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখলেন। পুত্রবধূ বলল, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি কী করে ফোন এলে রিসিভ করবেন, তারপর কথা শেষ হয়ে গেলে কী করবেন। বলে সে সেটটা হাতে নিয়ে ৫ মিনিটে দেখিয়ে বলল, এবার দেখাই কী করে কোন নম্বরে ফোন করবেন। কথা বলা শেষ হলে আগের মতোই অফ করবেন। শোনার পর খোরশেদ আলম বললেন, দাঁড়াও স্টেপগুলো লিখে রাখি। না হলে ভুলে যাব। পুত্রবধূ বলল, বেশ লেখে রাখেন। তবে দেখবেন কদিন ব্যবহারের পর আপনাকে আর দেখতে হবে না। সব আপনা থেকেই পারবেন।

ঠিক তাই হলো। কদিন পর তাঁকে আর নোট বই দেখে মোবাইল ব্যবহার করতে হলো না। এরপর পুত্রবধূ তাঁর পরিচিতদের নাম আর ফোন নম্বর লিখে দিল মোবাইল সেটে। কাউকে ফোন করার সময় তাঁকে আর টেলিফোন নোট বইটা দেখতে হয় না। আবার তাঁর পরিচিত কেউ যখন ফোন করে, তাঁর নাম ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। খোরশেদ আলম বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে মোবাইল সেট ব্যবহার করতে লাগলেন। আগের চেয়ে একটু বেশিই ফোনে আলাপ করলেন জানাশোনা মানুষ আর আত্মীয়দের সঙ্গে। আলাপের সময় জানাতে ভুললেন না নিজের মোবাইল থেকে ফোন করছেন।

কয়েক মাস পর ছেলের বউ একটা বড় সাইজের মোবাইল দিয়ে বলল, বাবা এখন এটা ব্যবহার করেন। স্মার্টফোন। এখানে অনেক ফাংশন আছে। বলে সে স্ক্রিনে রঙিন সব ছবি দেখাল। খোরশেদ আলম প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, না মা, ওটা আমি ইউজ করতে পারব না, খুব ঝামেলা মনে হচ্ছে।

পুত্রবধূ হেসে বলল, খুব সহজ বাবা। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

খোরশেদ আলম বললেন, আমার পুরনোটার চেয়ে এটা কেন ভালো?

পুত্রবধূ বলল, এটা দিয়ে শুধু ফোন না, অনেক কিছু করতে পারবেন। আমি শিখিয়ে দেব একটা একটা করে। দেখবেন আপনার অবসর জীবন কেমন উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। ভিডিওতে কথা বলবেন। ফেসবুকে যোগাযোগ করবেন।

খোরশেদ আলম বললেন, যোগাযোগ করব মানে? পুরনোটা দিয়ে বেশ যোগাযোগ করে যাচ্ছি। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

পুত্রবধূ হেসে বলল, নতুনটা দিয়ে যোগাযোগ আরও ভালো হবে। ছবি তুলতে পারবেন। সেই ছবি অন্যদের কাছে পাঠাতে পারবেন খুশি মতো।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, ছবি? ক্যামেরা দিয়ে কেমন করে?

পুত্রবধূ বলল, জি। এটার মধ্যে ক্যামেরা আছে। কী করে ব্যবহার করতে হয় আমি দেখিয়ে দেব। খুব সোজা।

এইভাবে শুরু। কয়েক মাসে খোরশেদ আলম ফেসবুকে পুরনো বন্ধু যারা তারা ছাড়াও বেশ কয়েকজন অপরিচিত ‘বন্ধু’ পেয়ে গেলেন। রাস্তায় হাঁটার সময় এভাবে তাঁর ছবি তোলা শুরু হলো। ছবি তুলে তিনি ফেসবুকে পোস্ট করলে সেগুলো দেখে ফেসবুক বন্ধুরা নানা মন্তব্য করে। বেশির ভাগই প্রশংসা। এতে তিনি বেশ উৎসাহ বোধ করেন। প্রতিদিনই হাঁটতে বেরিয়ে তিনি ছবি তোলেন। সেসব গ্যালারিতে জমা হয়। ভালোগুলো রাখেন, অন্য সব ডিলিট করে দেন। কিছু কিছু পোস্ট করেন। ভালো সাড়া পান ‘বন্ধুদের’ কাছ থেকে। ছবি তোলায় তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়।

২.

বিকালে ফুটপাত ধরে হাঁটছেন খোরশেদ আলম। যেতে যেতে তীক্ষè চোখে দেখছেন। তাঁর ডান হাতে মোবাইল ধরে রাখা। আইএমএ ক্যামেরা, কে বলেছিল এই কথা কোন বইতে? তিনি অতীত স্মৃতি ঘাঁটেন। এককালে খুব বিদেশি বই পড়েছেন, চাকরিতে ঢোকার পর সেই অভ্যাসে ছেদ পড়েছে। অবসরের এই সময় আবার ফিরে যাবেন ছাত্রজীবনের সেই অভ্যাসে, ভাবেন খোরশেদ আলম। কিন্তু এক নদীর এক স্রোতে দুবার পা দেওয়া যায় না, এ কথাও তো পড়েছেন তিনি। তা হলে? তার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায় সামনে তাকিয়ে। বেশ চমকে ওঠেন তিনি। ইস্কাটন গার্ডেনের রাস্তার পাশে ফুটপাতের শ্যাওলা পড়া দেয়ালে নানা ধরনের পোস্টার, হাতে লেখা বড় হরফে চিকা। সেসব পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে একজন। বাতাসে তার মাথার ওপরকার সাদা-পাকা চুল উড়ছে, নিচের চুল করোটিতে ঢেউ তুলে যেন বরফ-জমাট। কপালে কয়েকটি ভাঁজ, যেন কর্ষিত জমির এক আয়তখণ্ড। মুখে লোলচর্ম, ঠোঁটের দুই পাশে বলিরেখা। চোখ কোটরাগত হলেও খুব জীবন্ত। সেই চোখের দৃষ্টির কোনো ভাষা নেই, ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে আছে প্রৌঢ়া। তাঁর পরনের সবুজ শাড়ি ভাঁজহীন কিন্তু পরিষ্কার। তাঁকে দেখে ভিখারিনী মনে হয় না, বেশ একটা সম্ভ্রমশীল চেহারা, ব্যক্তিত্বময় তাঁর নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা। যেন ক্লান্ত হয়ে একটু বিরতি অথবা কারও অপেক্ষায়। নিচে পায়ের কাছে একটা তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটে কিছু টাকার ময়লা নোট পড়ে আছে শুকনো পাতার মতো। খোরশেদ আলম নিচের প্লেট থেকে চোখ তুলে প্রৌঢ়ার দিকে তাকালেন। এবার দেখলেন তার দুটি চোখ যেন জ্বলছে। তিনি হঠাৎ নার্ভাস হয়ে গেলেন সেই দৃষ্টির সামনে। এখন সেই দৃষ্টিতে তীব্র ভর্ৎসনা, ধারালো ধিক্কার। প্রৌঢ়ার ঠোঁট দুটি নড়ছে, বাতাসে বাঁশ পাতার মতো।

৩.

আমিন ফেসবুকে খোরশেদ আলম সাহেবের ফ্রেন্ড। বেশি দিন হয়নি, বছরখানেক হবে তার ওয়ালে স্ট্রিট ফটোগ্রাফি দেখে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধু হয়েছে। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে তাঁর রাস্তায় তোলা ছবি পোস্ট করেন। বেশ আকর্ষণ করে ছবিগুলো। দেখে মনে হয় কিছু বলতে চায়, সোশ্যাল কমেন্টারি ধরনের। সেনসেশনাল কিছু না। ভদ্রলোকের তোলা ছবি দেখে বোঝা যায় না, তিনি শখের, না প্রফেশনাল। তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে নাম, বয়স, ঠিকানা ছাড়া আর কোনো তথ্য নেই। তবে শখের উল্লেখ করেছেন, লিখেছেন বিকালে হাঁটা তার হবি। পড়ে মনে হয়েছে তিনি খুব সরল, না হলে বিকালে হাঁটাকে তিনি হবি বলতেন না।

আমি আজ তাঁর পোস্ট করা ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ছবির মানুষটা যেন তাঁর ধারালো চাউনি দিয়ে আমার  ভেতরটা দেখছে। এমন মানুষ তো কতই দেখি, এই বয়সের, এমন সাধারণ দেখতে, কিন্তু ফটোজেনিক চেহারা। এই ছবিতে আপাতদৃষ্টে যা দেখা যাচ্ছে তার অতিরিক্ত কিছু আছে যার জন্য অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়, এ এমন চেহারা যা একটু হলেও ভাবায়। মনে হয় খুব শান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু একটু ভালো করে তাকালেই বোঝা যাবে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও যেন আগুন জ্বলছে দুই চোখে। আরও এনিগম্যাটিক মনে হয় মানুষটার পেছনে ‘ঠিকানা’ কথাটি লেখা দেখে। খোরশেদ আলম পেছনে ওই কথাটি রেখে ছবিটা তুলেছেন। এত দিন যেসব ছবি দেখেছি তাতে মনে হয়েছে তিনি ফ্রেমে এমন কিছু আনেন না যা অপ্রয়োজনীয়। তিনি এই কথাটিসহ ছবিটা তুললেন কেন?   

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর