আগের মতো শুধু বাবুই পাখিদের কারুকাজময় দৃষ্টিনন্দন সুন্দর বাসাগুলো নেই। পুরনো বাসাগুলো বৃষ্টি-ঝড়ে হয়তো পড়ে গেছে সব। এখন ওখানে হাতেগোনা ক’টা গাঢ় সবুজ নতুন নীড় হাওয়ায় দুলছে। যেন ওতে কত কাব্যিক ছন্দ আঁকা। কে ‘যেন বলেছিলেন ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা করেছিনু আশা’। বাবুই পাখিদের সুখী ছবিটার কাছে নিজেকে দুঃখী মনে হয় লিপির...
ছোটগল্প
ছিমছাম গোছানো ঘরটা হঠাৎ করে যেন একটু একটু ভালোলাগার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। কতদিন হলো এমনটি হয় না। প্রায় বছর পেরুতে চলল বৈকি।
লিপি ভাবে। অসুস্থতার রেশটা কি প্রচ- একলা করে দিয়ে গেছে ওকে। এদ্দিন ওর নির্বাসিত সত্তায় ছিল শুধু চাপ চাপ যন্ত্রণার ব্যথাতুর মূর্ছনা। অস্বাভাবিকতার দ্বন্দ্বে ওর দিনরাত্রির সুদীর্ঘ সময় কেটেছে।
ডাক্তার প্রেসক্রিপশন ও ওষুধের টানাহেঁচড়ায় ওর নিজের অস্তিত্বটা এখন বেশ স্বাভাবিকতায় দাঁড়িয়ে গেছে। কিছুদিন থেকেই বেশ অনুভব করছে, নিদারুণ বিস্মৃতির যে পর্দাটা ওকে আষ্টেপিষ্ঠে যন্ত্রণার লতাগুল্মে বেঁধে রেখেছিল, ওটা এখন আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। কোন ফাঁকে বুকের চাপা বরফটা বোধহয় গলতে শুরু করেছে। আশপাশের ছায়াগুলোয় এখন তেমন প্রকট অন্ধকার নেই। আর সাথীহারা হাহাকারের তীব্রতাও এখন অনেক কম।
বহুদিন পর বিছানা ছেড়ে লিপি আজ একটু বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝুল বারান্দার গা-ঘেঁষে ইজিচেয়ারটা পাতা আছে দেখে মা ওকে বলে, ওখানে বোস লিপি। তুই তো এখনো পুরো সুস্থ নোস মা। চা দেবো একটু?
দাও।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়েও আবার আনমনা হয়ে যায়। দৃষ্টিটা উত্তরে প্রসারিত করে জাম গাছের ফাঁক দিয়ে যে এক চিলতে নীল আকাশ দেখা যায় সেখানেই বিরাট তালগাছটার শাখা পাতার পেলবতা ছড়িয়ে আছে দেখতে পায়। আগের মতো শুধু বাবুই পাখিদের কারুকাজময় দৃষ্টিনন্দন সুন্দর বাসাগুলো নেই। পুরনো বাসাগুলো বৃষ্টি-ঝড়ে হয়তো পড়ে গেছে সব। এখন ওখানে হাতেগোনা ক’টা গাঢ় সবুজ নতুন নীড় হাওয়ায় দুলছে। যেন ওতে কত কাব্যিক ছন্দ আঁকা। কে ‘যেন বলেছিলেন ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা করেছিনু আশা’।
বাবুই পাখিদের সুখী ছবিটার কাছে নিজেকে দুঃখী মনে হয় লিপির। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে ও উঠে দাঁড়ায়। ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। চার দেয়ালে দৃষ্টিটা এক পলক বুলিয়ে নেয় লিপি। গত বছরের আঁকা কিছু ছবি দেয়ালের গায়ে ঝুলছে। নিজের আঁকা ‘আকাশ ভরা তারা’ ছবিটাকে ওগুলোর ভিড়ে খুঁজে পায় না। পড়ার টেবিলটার দিকে দৃষ্টি নিতেই পাশের বুক সেলফে চোখটা আটকে যায়।
ও কে,
তারা?
একটু এগিয়ে এসে ছবিটা হাতে তুলে নেয়। চোখজুড়ে বোবা কান্না ছলকে ওঠে। তারা তুমি হারিয়ে গেলে কেন? কেন শুধু স্মৃতি হয়ে গেলে?
বড় ভাইয়ের বন্ধু তারা দুই বছর আগে ব্যাংকে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল। ভাইয়াকে খুঁজতে এসে লিপির সঙ্গেই বাড়ির দরজায় প্রথম দেখা। ভাইয়া তখন ড্রইংরুমে বসে সেদিনকার দৈনিক কাগজটা পড়ছিল। ওকে দেখেই ভাইয়া খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে তারা তুই।
হ্যাঁ, চাকরির জন্য এই তো গত সপ্তাহে এলাম।
এক সময় ভাইয়া লিপির সঙ্গে তারার পরিচয় করিয়ে দেয়-আমার ছোট বোন লিপি। ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। এবার পুরস্কার পেয়েছে ছবি এঁকে। দারুণ ভালো ছবি আঁকে।
তাই নাকি? বেশ তো তুই গাইয়ে, আর তোর বোন আঁকিয়ে। একেবারে দেখছি মানিকজোড়। তা আমার একটা ছবি এঁকে দেবে লিপি?
তারার গভীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে ও হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে ছিল সেদিন।
তারপর এক বছরে বাড়ির সঙ্গে তারার ঘনিষ্ঠতা যত বেড়েছে লিপি ও তারার নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসার বন্ধনটা ততই গভীর হয়েছে। অবশেষে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিতে ওদের পরিণয় মঙ্গলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল পনেরই মার্চ।
আর এক দিন। সেদিন ছিল বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী। লিপি ড্রয়িংরুমে বসে রবীন্দ্রসংগীত শুনছিল তন্ময় হয়ে। তারার প্রিয় গানগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শুনছিল ও। ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’।
ইতিমধ্যে কখন তারা এসে লিপির পেছনে দাঁড়িয়েছে ও টেরই পায়নি। চোখে হাত পড়তেই চমকে ওঠে বলে কে?
বোলবো না বোলবো না ওগো আমি কে? তারা গুনগুনিয়ে ওঠে।
ওহ্ তারা তুমি?
উহু! তারা তো আকাশে থাকে, আমি তোমার ছবি।
বেশ তো তাই। জানো ওই ছবিটা কালকে এঁকে শেষ করেছি। দেখবে? দাঁড়াও নিয়ে আসছি।
ফিরে এসে ছবিটা তারার হাতে দিয়ে বলে, কোনটা সত্যি ছবি না তুমি?
তারা ছবিটা টেবিলে রেখে লিপির কাছাকাছি দাঁড়ায়। ও লিপির মুখটা দু’হাতের মুঠোয় তুলে ধরে বলে তোমার চোখের আমিটাই সত্যি লিপি।
ভালোবাসার আদরে প্লাবিত হয়ে, লিপি এক সময় প্রশ্ন করে ছবিটা তুমি নেবে?
উহু! ওটা পনেরই মার্চ তোমাকেসহ নেবো।
দশই মার্চ তারা ওকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল সাভার স্মৃতিসৌধে। দুপুরের লাঞ্ছ সঙ্গে নিয়েছিল ওরা। সেদিনটা দারুণ সুন্দর কেটেছে ওদের। ফেরার পথে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। বাতাসের গায়ে কিছুটা ঠান্ডা আমেজ। ড্রাইভিং সিটে বসা তারার গায়ে ওর নীল শাড়ির আঁচল
মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে যাচ্ছিল। শ্যাম্পু করা চুলগুলো বাতাসে উড়ছিল। তারা তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে লিপি একটা গান শোনাবে লক্ষ্মীটি?
কি গান শুনবে? রবীন্দ্রসংগীত।
লিপি গায়- ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ শান্ত সুদূর আমার সাধের সাধনা’।
সুরের আবেসে ওরা দুজনেই বিভোর হয়ে থাকে। হঠাৎ রাস্তার বাঁকে উল্টোমুখী ট্রাকের সঙ্গে তারার কারটা প্রচ- ধাক্কা খেয়ে খাদে গড়িয়ে পড়ে যায়। দুজনকেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিতে হয়। তারা হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। তারার বুকে প্রচ- আঘাত লেগেছিল। কিন্তু লিপি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়ে কোনো মতে বেঁচে যায় সে যাত্রায়।
তাই তো আজ প্রায় বছরখানেক পর স্মৃতিরোমন্থনের পালায় লিপির চোখ দুটো ক্রমশ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। আকাশটা কখন যে মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে। লিপি খেয়াল করিনি। ওর হাতে তখনো নিজের আঁকা তারার জন্য আঁকা ছবিটা। এই সেই ছবি। ছবিটাই আজ আছে শুধু তারা নেই। ওর মন ব্যাকুল করে খোঁজে তারার অস্তিত্ব।
তারা তুমি এখন থাক কোথায়? তুমি কি আকাশে থাক?
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। লিপি জানালা দিয়ে বৃষ্টি ঝরা আকাশ দেখে। কোথাও তারা নেই। শুধু কালো কালো মেঘের মিনার আকাশজুড়ে। লিপি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। জানালার শিক ধরে হু-হু করে কেঁদে ওঠে। এ যেন মহাকালের জমান উত্তাল কান্না। শুধুই বয়ে যায় নদীর মতো।