আমি আর সুরবালা আমাদের আম বাগানে ফিসফিস করে কথা বলছি আর হাঁটছি। খয়েরি রঙের আমের কচি পাতার ওপর প্রজাপতি খেলা করছে। দৌড়ে প্রজাপতি ধরতে গিয়ে সুরবালার শাড়ির আঁচল জড়িয়ে গেল আমের ডালে। আমি পেছন থেকে তার নীল পাতলা শাড়ির আঁচল ছাড়িয়ে দিলাম। সুরবালা আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জার দেবী সাজলো। আমি তার ডাগর কালো চোখে তাকিয়ে কেমন যেন হয়ে গেলাম। তারপর কী হলো মনে নেই। ঘটনাটা বাস্তবে না স্বপ্নে।
সুরবালা তার আসল নাম না। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এক রাত্রি’ গল্পের নায়িকার নাম সুরবালা। আমার কাছে নামটি খুব পছন্দের। আমি তাকে এই নামেই ডাকতাম। ইচ্ছা থাকলেও আমি আর সুরবালা তাদের দলে নই, যারা বিয়ের আগেই সমাজচক্ষু আড়াল করে ভালোবেসে গোপনে সংসার বাঁধে। যখন সুরবালার বয়স এগারো কিংবা বারো তখন থেকেই ওকে ভালো লাগে। মনে মনে ভালোবাসার স্বপ্ন বুনছি।
আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করে অনার্সে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সুরবালার তখন উঠতি বয়স। সে তখন পুরোপুরি চোখের ভাষা বোঝে। ইশারায় কথা বলে। এক কলসি পানি এক গ্লাসে ধরে রাখা যতটা কঠিন তার চেয়েও কঠিন এক বাক্যে তার শরীরের রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা করা। সুরবালার সঙ্গে আমার দেখা হতো তার স্কুল শেষ করে বাসায় ফেরার পথে। কখনোবা প্রাইভেটে যাওয়া বা আসার সময়। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম।
এমনও সময় ছিল সুরবালার সঙ্গে দেখা হলে কথা হারিয়ে যেত, আবার কথা খুঁজে পেলে সুরবালা চলে যেত। এ নিয়ে তার বান্ধবীরা ব্যাপক হাসাহাসি করত।
এভাবে চার বছর কেটে গেল। সুরবালা আজকাল যেখানেই যায় আমি তার আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করি। তার তিলক মুখের হাসি দেখতে, তার ঘন কালো চুলের শোভা দেখতে জ্যৈষ্ঠ মাসের বড় বড় নীল রঙের মাছির মতো ভনভন করি। কথা বলার সুযোগ পেলেই সুরবালা আস্তে করে আমাকে ঠোঁটে টোকা মারে। এ নিয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে পণ করতাম ‘আজকের পর থেকে সুরবালার সঙ্গে দেখা হলে আমি আর কথা বলব না, যদি বলি তাহলে...’। রাতের বেলায় কী যেন হতো, দিনের বেলা সে পণ রক্ষা করতে পারতাম না।
সুরবালার ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। রাতের বেলায় পাগলের মতো কথা বলি। কলেজে ক্লাস না হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ঢাকা থেকে কবে বাড়ি এসেছি মনে নেই। মার অভিযোগ, আজকাল আমি নাকি সময়মতো খাবার খাই না, গোসল করি না। দিনদিন আমি নাকি কেমন হয়ে যাচ্ছি এলোমেলো, অগোছালো।
এখন শুধু সুরবালাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তার মুখচ্ছবি কল্পনা করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। এখন আমার স্বপ্ন, কল্পনা আর প্রত্যাশা সুরবালা আর সুরবালা।
সুরবালা আমাকে যতই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে আমি ততই তার কাছে আসি। কথা বলার সুযোগ খুঁজি। আমার সব প্রস্তাবের পর তার ক্ষীণ একটি প্রকাশ ‘সম্ভব না’। তার কাছে আমি আমার স্বপ্নের কথা বলব এমন সময় কিংবা সুযোগ কোনোটাই সে আমাকে দেয়নি। এটা আমারই ব্যর্থতা।
সুরবালা গোপনে আমার এক বন্ধুর কাছে নিয়মিত আমার খবর নিত। তার প্রমাণ পেলাম বহুদিন পর। সুরবালা তাকে বলতে বলেছে আমি যেন কাল সকাল সাড়ে ১০টায় প্রাইভেটে যাওয়ার রাস্তা ঘেঁষা সেই বড় আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি তার কথামতো সেই আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মনের মধ্যে কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময়।
কিছুক্ষণ পর হালকা গোলাপি রঙের থ্রি-পিস পরে রিকশা থেকে নেমে এলো সুরবালা। আমার বুকের ভিতরে কেমন যেন অনুভব হতে লাগল। এমনটা আর কোনো দিন লাগেনি। সুরবালা আমার কাছে এসে ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল- কেমন আছেন?
ভালো। তুমি?
এই তো। আসতে খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?
মোটেও না।
সুরবালা কথা বলছে আর ডান হাত দিয়ে তার বাম হাতের আঙুল মটকাচ্ছে। আমি স্বাভাবিকভাবেই তার প্রশ্নের জবাব দিলাম। সুরবালা একটু মাথা নিচু করে বলল, আপনি হয়তো বুঝতে পারেননি যে, আমিও আপনাকে ভালোবাসি। কবে থেকে ভালোবাসি তা মনে নেই। এতদিন বলিনি ইচ্ছে করে, কিন্তু আজ আর মনের কথাটা না বলে পারলাম না।
আজ ওর কথায় কোনো ভণিতা নেই। এতো মায়া এতো আবেগ মিশিয়ে সুরবালা কথা বলতে পারে আমার ধারণাই ছিল না। আজ আমার সমস্ত অস্তিত্বে নতুন মহিমায় প্রবেশ করল ছদ্মনামের এই সুরবালা। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে দিল আকস্মিক দক্ষিণা বাতাস। সৃষ্টি হলো আমার ভিতর নতুন এক আমি।
সুরবালা মুহূর্তের মধ্যে চুপ হয়ে গেল। ওর মুুখের দিকে অনন্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালাম। তারপর বলল- আমার মন বলছে আজই আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আজ দুপুরে আমরা সবাই সখীপুর ছেড়ে টাঙ্গাইল চলে যাচ্ছি। জীবনে আর কোনো দিন সখীপুর আসব কিনা জানি না।
সুরবালার কথার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে এ ঘটনা আর স্বপ্ন মনে করতে পারলাম না। সুরবালার কান্না দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেল। কেউ কোনো কথা বলতে পারছি না। আমি তার নিঃশ্বাসের আঙিনায় গিয়ে চোখের জল মুছে দিলাম। ও আরও গুমরে কাঁদতে লাগল। চোখের পানিতে আমার দুই হাতের আঙুল ভিজে গেল। সেদিনই প্রথম কোনো নারীর কপাল, চোখ, চোখের পাপড়ি স্পর্শ করলাম।
এক সময় সুরবালা কান্না থামিয়ে স্থির হলো। কোনো কথা না বলে ভেজা চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকালো। তারপর লুকিয়ে রাখা ছোট্ট একটা চিরকুট দিলো আমার হাতে। আমি সেই চিরকুট হাতে নিয়ে সুরবালার দিকে তাকালাম। সুরবালা রিকশায় উঠে কান্নাভেজা চোখ তুলে বারবার পেছনে ফিরে তাকালো। সে দূর থেকে হাত নাড়ল। আমার হাত উঁচু করতে গিয়ে চিরকুটটা মাটিতে পড়ে গেল। দ্রুত তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলে পড়ে দেখি চিরকুটে লেখা ‘আপনার চোখকে হৃৎপিণ্ডকে মুক্তি দিন তারা নতুন সৌন্দর্য, নতুন ভালোবাসা খুঁজে নেবে।’
অতঃপর কে যেন আমাকে সান্ত্বনা জানিয়ে বলল- তুমি যদি তার জীবনে প্রথম হয়ে থাক তাহলে সে তোমাকে কোনো দিন ভুলতে পারবে না।