গল্প
রাস্তাঘাটে কাউকে বিশ্বাস করেন না তিনি। সব সময় সতর্ক থাকেন। আতিক সাহেব আজ একটু আগেভাগেই বের হলেন। লাঞ্চের পর অফিসে কাজের তেমন একটা চাপ নেই। সহকর্মী দিলারা আপাকে ‘কোনো অসুবিধা হলে দেখবেন’ বলে বের হলেন। সদরঘাটের ঘিঞ্জি পরিবেশ আতিক সাহেবের ভালো লাগে না। তবুও যেতে যেতে বছর পনেরো কেটে গেল একই অফিসে। অফিসের টেকনিক্যাল হ্যান্ড সাইডে কাজ করেন। একটি বাড়তি সুবিধা আছে এ সাইডে। প্রতিস্থাপক না পেলে সহজে বদলি হয় না। টাইপরাইটার হিসেবে শুরু করেছিলেন। ডিজিটালাইজড অফিসে এখন কম্পিউটার অপারেটর তিনি।
রাস্তায় বেরুলে জগন্নাথ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের সামনে পড়তে হয়। আজকালকার ছেলেরা মুরুব্বিদের সালাম দেয় না। অথচ এক সময় যখন গ্রামের পথ ধরে কোনো ছেলে যেতো, মুরুব্বি দেখলেই বিনয়ে রাস্তার একপাশে সরে যেতো, সালাম দিতো। স্মৃতির পাতায় বিচরণ করতে করতে আতিক সাহেব রাস্তা পেরুচ্ছিলেন। জগন্নাথ পার হয়ে একটি টঙঘর দোকানে চা খাওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। পেছন থেকে সিগারেটের ধোঁয়া এসে আচ্ছন্ন করলো আতিক সাহেবকে। বিরক্ত হলেন, অসম্ভব বিরক্ত। মনে মনে ভাবলেন, কী বেয়াদপ ছেলে! তবুও জোর করে চা-টা উপভোগ করার চেষ্টা করলেন। চা শেষ করে একটা বাবা জর্দা দেওয়া পান না খেলে কি চলে! ...এই চুন একটু বাড়িয়ে দাও। আজকাল দোকানিরা সুপারি দিতে কার্পণ্য করে। পান খেতে খেতে আলাপজুড়ে দেন মধ্যবয়সি এক লোকের সাথে। বুঝলেন ভাইসাব, আজকাল সবকিছুই খারাপ হয়ে গেছে। সমাজে সিস্টেম টিস্টেম নাই। এথিক-টেথিক এখন আর পড়ানো হয় না।
আজ দুদিন ধরে মনটা তেমন ভালো নেই আতিক সাহেবের। বড়ো ছেলেটা মহল্লার বাজে ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়। এই নিয়ে ঘরে বউয়ের সাথে মেজাজ দেখিয়েছেন আতিক সাহেব। পরীক্ষায় অংকে পেয়েছে এগারো। এ বছরই এসএসসি। প্রিটেস্ট পরীক্ষায় এই অবস্থা! তাই টেনশন একটু বেশি। সেটার জন্যে মেজাজ যতটানা খারাপ, তারচেয়ে বেশি স্ত্রীর আচরণে। সব সময় ছেলেকে ডিফেন্ড করতে চায় প্র্যাকটিসিং ল’ ইয়ারের মতো। আতিক সাহেব খিট খিট করে উঠে মাঝে মাঝে বলেন : এই মহিলাডাই পোলাডারে নষ্ট করেছে!
সমস্যা বোঝার দরকার নেই। সময়ও নেই আতিকের। সবকিছুকে এতো ভিন্ন ভিন্ন অ্যানালাইসিস করার সময় কোথায়। মাঝে মাঝে মনে হয় দুনিয়াটা তার সঙ্গে যাচ্ছে না। কী করবে! এভাবেই চলতে হচ্ছে।
আজমেরী পরিবহনের একটি গাড়িতে ভিড় ঠেলে উঠলেন আতিক সাহেব। ভিড় ঠেলে ঠেলে বাসের পেছনে গেলেন। অসহ্য লাগে বেয়াদব ছেলেগুলোকে দেখলে। মুরুব্বিদের সামনে বাসের সিটে বসে থাকে। আর মুরুব্বিরা থাকেন দাঁড়িয়ে। এদের সম্পর্কে কেন জানি একটা ঘৃণা আর অবিশ্বাস জমে উঠেছে তার মনে। টার্গেট উঠতি তরুণরা। স্ত্রী বলেন, আপনার দোষ হচ্ছে আপনি সবাইরে এক করে দেখেন। স্ত্রীকে ধমকিয়ে থামিয়ে দেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসার একটা সিট পেলেন জানালার পাশে। তাঁতিবাজার পর্যন্ত আসতেই চল্লিশ মিনিট লাগালো বাস। বাস তো অ্যারোপ্লেন নয় যে রুট বদল করে উড়ে যাবে। বাসকে জ্যাম মেনে এগুতে হয়। আতিক সাহেব ভাবেন কারো ধৈর্য পরীক্ষা করতে হলে তাকে বাসের ড্রাইভার হতে হবে। আহা! আমার ছেলেটা যদি এই ড্রাইভারদের মতো হতো- দ্যাখো তো কত কম বয়সি ছেলে। তবু কী ধৈর্য। প্রচণ্ড গরমে হাঁফিয়ে উঠেছেন আতিক সাহেব। ফুলবাড়িয়ায় এসেই কোনো রকমে বাসের জানালার একটা গ্লাস একটু ফাঁক করে দিয়েছেন। একটু তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিলেন। বাসে বসে পাশের সিটের এক যুবকের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠলেন। এরকমটি খুব একটা হয় না। এই যুবককে দেখে মনে হয়েছে জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তাকে প্রশংসা করে বললেন : বাবা, তোমার মতো ভদ্র মেধাবী ছেলে ঘরে ঘরে থাকলে জাতি এগিয়ে যাবে। মনে মনে ভাবলেন, তার নিজের ছেলেটা যদি এরকম হতো! কী ভদ্র! কী অমায়িক ছেলে! আতিক সাহেব অবশ্য এমন ভদ্র ছেলেদের সন্ধান পেলে নিজেও ভদ্রতা দেখাতে কার্পণ্য করেন না। কি যেন কি কথা ভাবতে ভাবতে চোখে তন্দ্রা এলো। গাড়ি হার্ড ব্রেক করলে আবার নড়ে-চড়ে বসেন। এভাবেই চলতে লাগলো। এভাবেই ঢাকার পেসেঞ্জাররা চলেন। গোলাপ শাহ মাজার সিগনালে বাস কখনো স্লো, কখনো গতি বাড়িয়ে চলছে। যাত্রীরা কেউ কেউ নামছেন। কেউ কেউ উঠছেন। বাইরে সেই ঘিঞ্জি পরিবেশ। গুলিস্তান বলে কথা। এসব আতিক সাহেবের অ্যালার্জি। এভাবে চলা যায়? ঢাকার এই জায়গাটার মোটেই স্ট্যাটাস নেই। অন্তত আতিক সাহেবের মতো লোকদের জন্য। জানালা দিয়ে দেখেন তার গাড়ি ঘেঁষে যাচ্ছে আরেকটি গাড়ি। আতিক সাহেব ঘ্যাঁত ঘ্যাঁত করে উঠলেন। ঐ গাড়ির হেলপারকে দিলেন কঠিন এক অশ্রাব্য গালি। ভাগ্যিস সে শোনেনি। শুনলে এলাহিকাণ্ড ঘটে যেতো হয়তো। গুলিস্তান বলে কথা। মেজাজ তো আর সব সময় সব জায়গায় খাটে না। বউয়ের এই কথাটা তার মনে পড়লো হঠাৎ। তারপর থেমে গেলেন নিজে নিজেই।
গাড়ির পাশ ঘেঁষে রাস্তা পার হচ্ছিল সেই ছেলেটি, যে কিছুক্ষণ আগেও আতিক সাহেবের পাশে বসা ছিল এই বাসেই। কখন যে উঠে গেছে আতিক সাহেব তা খেয়াল করেননি। খেয়াল করবেনওবা কিভাবে? কতোক্ষণ আর খেয়াল রাখা যায়। হঠাৎ অফিস থেকে দিলারা আপার ফোন। তলপেটে এক কামড় দিলো আতিক সাহেবের। ঘড়িতে পৌনে পাঁচটা। অফিসে কোন ভিজিট টিম এলো না তো? ফোন ভয়ে ভয়ে বের করে কানের কাছে ধরলেন আতিক সাহেব। হ্যালো.., দিলারা আপা! বলতে না বলতেই কে যেন চট করে কানের কাছ থেকে ফোনটা দিল টান। আচমকা তাকিয়ে দেখেন সেই ছেলেটিই মোবাইল ফোনটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছে, যে তার পাশে বসা ছিল কিছুক্ষণ আগেও। আতিক সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। কতক্ষণ বোবার মতো ওঁ-আঁ করলেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই সব যেন ঘটে গেল। বাসের যাত্রীরা দেখেও না দেখার ভান করলো। কেউ একজন বলে উঠলো : চোখ-কান খোলা রাখতে পারেন না? বাসে জানালার পাশে বসে কেউ মোবাইলে কথা বলে? দোষ যেন তারই। কিন্তু মোবাইল সেটটি উদ্ধারের তৎপরতা কেউ দেখালো না।
পাশের গাড়ির হেলপার এ দৃশ্য দেখেছিল। সেই ঝাঁপ দিয়ে পড়লো মোবাইল ছিনতাইকারীর ওপর। কলার চেপে ধরলো তার। চারদিক থেকে লোকজন জড়ো হয়ে এলো। উত্তম-মধ্যম দিয়ে মোবাইলটি উদ্ধার করল। আতিক সাহেব গাড়ির গ্লাসের ভেতর থেকে যে ছেলেটিকে গালি দিয়েছিলেন, সে-ই বীরোচিত এই কাণ্ড ঘটালো। আতিক সাহেবের বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের চোখকে। এখনো তার গা কাঁপছে। আইল্যান্ডের ওপর থাকতেই দিলারা আপার আবার ফোন। হ্যালো : আতিক সাহেব কথা বলছেন না কেন? কিসের এতো হইচই হচ্ছে? আতিক সাহেব ফোন রিসিভ করতে সবুজ বাটনে টিপ দিলেন। ফোনটা কানে ধরলেন। কিন্তু কথা বলতে পারলেন না। শুধু বললেন : হ্যালো! দিলারা আপা...। একথা বলতে বলতে দুই চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। জোর করে ঠোঁট কাঁপা বন্ধ করতে চেষ্টা করলেন।