শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
শাবি শিক্ষার্থীদের হাইড্রোলিক র‌্যাম পাম্প

বান্দরবানে ১৪ পরিবারের মুখে হাসি

জুবায়ের মাহমুদ, শাবি প্রতিনিধি

বান্দরবানে ১৪ পরিবারের মুখে হাসি

বান্দরবান জেলার থানচি থানার বলিপাড়া ইউনিয়নের ফোহ্লাচিংপাড়া। ফোহ্লাচিংপাড়ার আবার দুটি ভাগ রয়েছে।  এর মধ্যে একটি হচ্ছে মারমা পাড়া। মারমাপাড়ায় মূলত ১০টি পরিবারের ৩৫ জন মানুষের বসবাস। যুবকদের চেয়ে সেই পাড়ায় নারী ও শিশুদের সংখ্যাই তুলনামূলক বেশি। ফলে প্রত্যেকটি পরিবারের অর্থনৈতিক ও গৃহস্থালি উভয় কর্মকাণ্ডেই পুরুষদের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ বেশি লক্ষ করা যায়। তাদের গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হচ্ছে পানি আনা। মূলত তারা যে জায়গায় বসবাস করে তার থেকে ৮০০ ফুট দূরে ও ৫০ ফুট নিচে পানির ঝরনা। যদি কেউ সকালে মারমাপাড়ায় যায় তবে সে দেখবে লাইন ধরে নারী ও শিশুরা উঁচু-নিচু, পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে পানি আনছে। তারা দিনে ৪-৫ বার যাওয়া- আসা করে এবং প্রায় ৯০ লিটারের মতো পানি নিচের ঝরনা থেকে লোকালয়ে  নিয়ে আসে। এলাকার নারী ও শিশুরা দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে সেই ঝরনা থেকে গোসল, খাবার ও রান্নার পানি সংগ্রহ করে। পানি আনতে গিয়ে খাড়া পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির সময় পা ফসকে যাওয়া ও পাহাড়ি পানির ঢলে ভেসে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা হরহামেশাই এখানে ঘটে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা সময় নষ্ট হয় শুধু খাবার ও গোসলের পানি সংগ্রহের জন্যই।

এমন পরিস্থিতিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইই) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সৌমিক আহমেদের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তৈরি করেছেন এক ধরনের হাইড্রোলিক র‌্যাম পাম্প। এই ধরনের পাম্প মূলত পানির চাপকে কাজে লাগিয়ে নিচু এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়া পানি সরবরাহ করে থাকে। ফোহ্লাচিংপাড়ায়  কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াই এই পাম্প লোকালয় হতে ৫০ ফুট নিচের ঝরনা থেকে পানি তুলে একটি ট্যাংকে সংগ্রহ করে। বর্তমানে দৈনিক ৪৩২০ লিটারের মতো পানি তুলে এই বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন পাম্প।

বান্দরবান জেলা সদরের ফারুকপাড়াতেও ৪টি পরিবারের জন্য একই ধরনের পাম্প তৈরি করে দেন সিইই বিভাগের সেই শিক্ষার্থীদের দল। লোকালয় থেকে প্রায় ৯০ ফুট নিচের ঝরনা থেকে এই পাম্পের মাধ্যমে সহজেই পানি পাচ্ছে সেই এলাকার অধিবাসীরা। ফলে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপজ্জনক পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে পানি আনতে হচ্ছে না ফোহ্লাচিংপাড়া ও ফারুকপাড়ার ১৪টি পরিবারের সদস্যদের। এই সুবিধা পাওয়ায় হাসি ফুটেছে সেইসব এলাকার অধিবাসীদের। ফোহ্লাচিংপাড়ার অধিবাসী উ লা থং মুঠোফোনে বলেন, ‘আগে অনেক কষ্ট করে কলসি দিয়ে পাহাড়ের নিচের ঝরনা থেকে পানি আনতে হতো। পাম্প হওয়ার পর আমাদের কষ্ট অনেক কমে যায়। এই পানি আমরা খাবার, রান্না ও গোসলের কাজে নিয়মিত ব্যবহার করি।’

 

সাফল্যের পেছনের গল্প

বছর দুয়েক আগে শাবির সিইই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. বিজিত কুমার বণিক ক্লাসে ‘ওয়াটার হ্যামার ইফেক্ট’ নিয়ে লেকচার দেওয়ার সময় ‘হাইড্রোলিক র‌্যাম পাম্প’র কথা উল্লেখ করেন। সৌমিক বিষয়টাতে ভালো আগ্রহ পায়। এর কিছুদিন পরই একটি ফেসবুক গ্রুপে তিনি একটি ছবি দেখতে পান, যেখানে বান্দরবানের এক ত্রিপুরা মেয়ে খাড়া পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে কলসিভর্তি পানি নিয়ে যাচ্ছে। সেই সময়ই সৌমিকের মাথায় আইডিয়া এলো যে, ‘হাইড্রোলিক র‌্যাম পাম্প কেন বান্দরবান নিয়ে যাচ্ছি না’। তিনি তার এই আইডিয়া ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত ‘সলভ-এ-থন’ প্রতিযোগিতা করেন। ‘সলভ-এ-থন’ প্রতিযোগিতা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেশের কোনো সমস্যা ‘উদ্ভাবনী কোনো আইডিয়া’ দিয়ে নিরূপণ করার চেষ্টা করে। এই প্রতিযোগিতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘একসেস টু ইনফরমেশন’ প্রোগ্রামের অন্তর্গত। শাবির সৌমিক আহমেদ এই প্রোগ্রামে বান্দরবানে হাইড্রোলিক র‌্যাম পাম্প নিয়ে যাওয়ার আইডিয়া প্রেজেন্ট করে বিজয়ী হন। এই আইডিয়া পরবর্র্তীতে প্রজেক্ট আকারে নেয়া হয় এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তাকে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার ফান্ড দেওয়া হয়। প্রজেক্টের নাম ছিল “ Pumping water from downhill source to uphill.” এই প্রজেক্টের মেনটর ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ড. আরিফ ইফতেখার ও শাবির সিইই বিভাগের ড. বিজিত কুমার বণিক। গত বছর তারা এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য স্থান হিসেবে বান্দরবান জেলার থানচি থানার ফোহ্লাচিংপাড়া ও সদরের ফারুকপাড়াকে নির্ধারণ করেন। এর আগে তাদের তৈরি হাইড্রোলিক র‌্যাম পাম্প ‘এ টু আই’ এর ‘আইল্যাব (ইনোভেশন ল্যাব)’ এ পরীক্ষা, গবেষণা ও কারিগরি উন্নয়ন করা হয়।

 

প্রজেক্টে আরও যারা আছেন

প্রজেক্ট টিমের সব সদস্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি)  সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইই) বিভাগের শিক্ষার্থী। প্রজেক্ট লিডার হলেন সৌমিক আহমেদ। অন্যরা হলেন তনিম তাহমিদ খান, জহিরুল ইসলাম, এস এম শরিফুল ইসলাম, রাহাত আহমেদ, মাহমুদ ইবনে সাদেক, আশরাফ উল্লাহ, আজিমুল ইসলাম, ইয়াহহিয়া আল সাবেত, শরিফুল ইসলাম শাকিল ও মাকসুদুল ইসলাম।

 

ভবিষ্যতে তৈরি হবে ইরিগেশন পাম্প

পার্বত্য অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ অর্থকষ্টে দিনযাপন করে থকেন। তবে এখন অনেকেই মিশ্র ফল বাগানের চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। মিশ্র ফল বাগানের মধ্যে রয়েছে কাজুবাদাম, মাল্টা, পেঁপে, জাম্বুরা, পেয়ারা, ড্রাগন ফল ইত্যাদি। তবে এই মিশ্র ফল বাগান চাষের জন্য প্রয়োজন প্রচুর পানি যা পাবর্ত্য অঞ্চলের অনেক এলাকায় অপর্যাপ্ত।  সৌমকদের ইচ্ছা তাদের জন্য খুব শিগগিরই ইরিগেশন পাম্প তৈরি করা। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে গবেষণা সেল তৈরির ইচ্ছাও রয়েছে তাদের। পার্বত্য অঞ্চলে হাইড্রোলিক র‌্যাম পাম্প তৈরির স্বপ্নদ্রষ্টা সৌমিক আহমেদ বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের উঁচু এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা বাসস্থান থেকে অনেক নিচের এলাকার ঝরনা থেকে পানি আনে। যা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ, কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। এর থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সহজলভ্য সব জিনিস দিয়ে আমরা তৈরি করেছি বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন হ্যান্ডমেড এই পাম্প। বিনামূল্যে পাম্প বসানোর পর এলাকার মানুষকে এর ব্যবহার সম্পর্কে স্বল্প ট্রেনিং দেওয়া হয়।’

সর্বশেষ খবর