শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
অর্জন

ফিফা রেফারি জয়ার স্বপ্ন পূরণ

রাশেদুর রহমান

ফিফা রেফারি জয়ার স্বপ্ন পূরণ

ঝুলন্ত ব্রিজ, কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝরনা, বন্যহাতি আরও কত কী যে আছে রাঙামাটিতে। পার্বত্যাঞ্চলের এই জেলার নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। তবে দিন বদলে গেছে। সুনাম-সুখ্যাতিতে রাঙামাটির পালকে যোগ হয়েছে ভিন্ন নাম। যে নাম দেশের গ-ি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বমঞ্চে। জয়া চাকমা। রাঙামাটির এই মেয়ে কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ে রাঙামাটি আর বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছেন অভূতপূর্ব এক গৌরব। ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার তালিকাভুক্ত রেফারি হয়ে গেলেন তিনি। পরীক্ষা দিয়ে পাস করে আগেই ইতিহাস গড়েছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন ফিফার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির। এবার তাও পেয়ে গেলেন। বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি এখন জয়া চাকমা। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় জয়াসহ পাঁচজন নারী ফিফা রেফারি আছেন। ভারতের রঞ্জিতা ও রুবা দেবি এবং নেপালের অস্মিতা ও ভুটানের চুকিউম।

মেয়েদের নিয়ে সমাজে অসংখ্য ভুল ধারণা আছে। এমনকি এই আধুনিক যুগেও। এখনো মেয়েদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বাবা-মাকে নানান দিক চিন্তা করে দেখতে হয়। নিরাপত্তা নিয়ে রাত-দিন দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। প্রফেশন নিয়ে চিন্তা করতে গেলে নানান বাধা সামনে আসে। অনেক পরিবার তো লেখাপড়াটাই ঠিকমতো  করতে দিতে চায় না। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক মেয়েই নিজের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে না। সেখানে খেলাধুলা করা অনেক বড় ব্যাপার। ফুটবল নিয়ে মাঠে দৌড়ানো, ব্যাটে-বলে ক্রিকেট খেলা কিংবা আরচারিতে নাম কুড়ানো। কিন্তু শত বাধা থাকার পরও মেয়েরা আরচারিতে সোনার পদক উপহার দিয়েছে দেশকে। ক্রিকেটে আছে অনেক সোনার মেয়ে। ফুটবলেও দুর্দান্ত খেলছেন কৃষ্ণা রানী আর মারিয়া মান্ডারা। এবার রেফারিংয়েও ফিফার স্বীকৃতি অর্জন করলেন এক মেয়ে। তিনি জয়া চাকমা। পাহাড়সম সামাজিক বাধা অতিক্রম করেই সফলতা ছিনিয়ে এনেছেন তিনি। এক সময় যারা সমালোচকের দৃষ্টিতে তাকাত সেই তারাই এখন প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন জয়াকে।

ফিফা তালিকাভুক্ত হওয়ার পর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে জয়া চাকমার। সামনের বছরই দেশে-বিদেশে ফিফা ম্যাচ পরিচালনা করতে পারবেন তিনি। কিন্তু এ পর্যায়ে আসতে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। রাঙামাটির মেয়ে জয়া। শৈশবেই খেলাধুলার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। স্কুলের খেলায় অংশ নিতে নিতে প্রেমে পড়ে যান খেলাধুলার। ফুটবলের পাশাপাশি হ্যান্ডবল আর ক্রিকেটটাও দারুণ খেলতেন জয়া। জেলা পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছেনও। তবে ফুটবলের প্রতি ভালোলাগাটা বেড়ে যায় ২০০৭ সাল থেকে। ইন্দো-বাংলা গেমসের দলে স্থান পান তিনি। এরপর থেকে ফুটবলকেই ধ্যান-জ্ঞান করেন। ২০১২ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর ভিন্ন চিন্তা করতে থাকেন তিনি। রেফারিংকে গুরুত্ব দেন সর্বোচ্চ। পাশাপাশি কোচিং কোর্সও করে রাখেন। অবশ্য ২০১০ সাল থেকেই রেফারি হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন তিনি। সে সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়তেন তিনি। এরও আগে পড়াশোনা করেছেন রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং রাঙামাটি সরকারি মহিলা কলেজে। বর্তমানে বিকেএসপির নারী ফুটবল দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জয়া চাকমা। ২০১০ সালে ফিফা রেফারিংয়ের ‘ক্লাস থ্রি কোর্স’ করেন তিনি। ২০১৩ সালে করেন ‘ক্লাস টু কোর্স’। ২০১৬ সালে হন জাতীয় রেফারি। এর পরপর দুই বছর ফিফা রেফারির পরীক্ষা দিলেও পাস করতে পারেননি। তৃতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন। এবার স্বীকৃতিটাও পেয়ে গেলেন। সাবেক এই নারী ফুটবলার কোচ হয়েছেন আগেই। এএফসি ‘বি’ লাইসেন্সধারী কোচ তিনি। জয়া চাকমার লক্ষ্য এখন দেশের বাইরে গিয়ে কোচিংয়ের ওপর এএফসি ‘এ’ লাইসেন্স কোর্স সম্পন্ন করা। বাফুফের সাবেক টেকনিক্যাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ডাইরেক্টর পল স্মলির অধীনেই তিনি বিদেশে এই লাইসেন্স অর্জন করতে চান।

জয়া চাকমা কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন ফিফা রেফারির সনদ। তিনি বলেন, ‘অনেক দিনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে বলে ভীষণ আনন্দিত।’ ২০১২ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নিয়মিত রেফারিং শুরু করেন জয়া চাকমা। এরপর একে একে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা পরিচালনা করেছেন শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও তাজিকিস্তানে। ২০১৫ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে ১০টি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। এ ছাড়াও জয়া বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে পরিচালনা করেছেন মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের ম্যাচ। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তিনি ৩৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। কোচ হিসেবে কাজ করলেও স্বপ্নটা রেফারিংকে ঘিরেই। জয়া বলেন, ‘আমার প্রথম লক্ষ্যই থাকবে যেন ফিফার এলিট প্যানেলে ঢুকতে পারি। এর বাইরে মেয়েদের ফুটবল উন্নয়ন নিয়েও কাজ করতে চাই। সেটা কোচিং বা রেফারিং যেটাই হোক না কেন।’

বাংলাদেশে মেয়েদের খেলাধুলার সংস্কৃতিটা বদলে দিতে চান তিনি। হতে চান পথিকৃৎ। একাধারে কোচ ও রেফারি। দুটোকেই দারুণ উপভোগ করেন জয়া চাকমা। কোচ হিসেবে চাকরি করছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)। আর ১০ বছরের কঠোর সাধনার পর হয়েছেন ফিফা রেফারি। আগামী বছর ২০২১ সালের জন্য পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে চান জয়া চাকমা। রেফারিং নিয়েই এবার বহুদূর এগিয়ে যেতে চান।

সর্বশেষ খবর