শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
সাফল্য

পলিথিনের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ

ড. মোবারক আহমদ খানের উদ্ভাবন

আকতারুজ্জামান

পলিথিনের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ

ড. মোবারক আহমদ খান

পরিবেশ বিধ্বংসী পলিথিনের কারণে সৃষ্ট নানা সমস্যার সমাধান হতে পারে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ। কারণ, সোনালি ব্যাগ পলিথিনের ব্যাগের মতোই সহজে বহনযোগ্য, মাটিতে পচে যায়। এটি সম্পূর্ণভাবে ন্যাচারাল পলিমার। এখানে কোনোরকম সিনথেটিক পলিমার ব্যবহার করা হয় না। এতে কোনো প্লাস্টিক উপাদানও নেই। এই ব্যাগ পানিতে গেলে পানিরও কোনো ক্ষতি হয় না, তৈরি হয় না জলাবদ্ধতার। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে এই সোনালি ব্যাগেই সারা বিশ্বে ব্র্যান্ড হতে পারে বাংলাদেশ। পাইলট প্রকল্পে উৎপাদন শেষে এই ব্যাগ এখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের অপেক্ষায়।

১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি মানিকগঞ্জে জন্ম নেওয়া ড. মোবারক আহমদ খান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলস থেকে পলিমার কেমিস্ট্রি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়াও জার্মানি, জাপান, আমেরিকা থেকে পোস্ট ডক্টরেট সম্পন্ন করেন তিনি। ২০১৭ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহাপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন ড. মোবারক আহমদ খান। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত আছেন।

ড. মোবারক আহমদ খান ২০০১ সালে পাটের তৈরি পরিবেশবান্ধব ঢেউটিন উদ্ভাবন করেন, যা জুটিন নামে পরিচিত। জুটিন তৈরিতে তিনি পাটের সঙ্গে ব্যবহার করেন পলিমারের মিশ্রণ। জুটিন দ্বারা ঘরের চালের টিন, গৃহস্থালির বিভিন্ন আসবাবপত্র দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করা যায়। পাট ও পলিমার মিশ্রণের মাধ্যমে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি করেন তিনি। যা দিয়ে আসবাবপত্র, গাড়ির বডি ও প্লেনের বিভিন্ন অংশ তৈরি করা যায়। এরপর পাট থেকে তিনি সেলুলোজ ন্যানো ক্রিস্টাল/ন্যানো ফাইবার আহরণ ও এর ব্যবহারের ওপর ব্যাপক কাজ করেন। তিনি বলেন, আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে দেখলাম ঢেউটিনের বিশাল চাহিদা। জুট থেকে টিন উদ্ভাবন করলাম, যা ‘জুটিন’ নাম দেওয়া হলো। সারা বিশ্বে এটি তখন ব্যাপক সাড়া ফেলল। এটা দেখতেও সুন্দর, আরামদায়ক, টেকসইও বটে। শীতকালে ভিতরে খুব শীত লাগে না, গরমকালে বেশি গরমও লাগে না। ইন্টারনাল ফেন্সিং থেকে শুরু করে ঘরের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ নানা জিনিসপত্রও এই জুটিন দিয়ে তৈরি করা সম্ভব। এরপর পাট থেকে চেয়ার-টেবিল দরজাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। জুটিন দেখে অনেক প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করল। কিন্তু হাতে বানানো জুটিনের উৎপাদন ব্যয় বেশি হলো। মেশিনে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে দাম অনেক কমে আসত। আশার বাণী হচ্ছে ‘দি আমেরিকান এপ্লাইড বায়োপ্লাস্টিক’ এটাকে পাইলট প্রকল্পে উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য হাউজিংয়ে এই জুটিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এরা লাভবান হলে সেটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যেতে পারে।

গবেষণায় ও উদ্ভাবনে অসাধারণ অবদানের জন্য এই বিজ্ঞানী অর্জন করেছেন বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল (২০১০), জাতীয় পাট পুরস্কার (২০১৭), এশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি ফেডারেশন (২০০৭), জাতীয় পরিবেশ স্বর্ণপদক ২০১৯-সহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কার ও সম্মাননা।

নানা আবিষ্কারের মধ্যে ড. মোবারক আহমদ খানের অন্যতম আবিষ্কার হলো- পাট থেকে পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ (সোনালি ব্যাগ) তৈরি। এ ছাড়া গরুর হাড় থেকে ক্ষত নিবারণের ব্যান্ডেজের উন্নত উপাদান, টেক্সটাইলের তরল বর্জ্য থেকে তরল জাতীয় জৈবসার, চিংড়ি মাছের আঁশ থেকে প্রাকৃতিক উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক এবং ২০১৬ সালে তিনি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ফরমালিনের বিকল্প হিসেবে অ-ক্ষতিকারক কাইটোসান তৈরি করেন তিনি।

সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবনের সময়গুলোর কথা স্মরণ করে এই বিজ্ঞানী বলেন, পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে দেখলাম দেশের পাটজাত পণ্য পলিথিন বা সিনথেটিক ফাইবারের সঙ্গে বাজারে টিকতে পারছে না। অথচ পলিথিনের নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি সত্ত্বেও এর চাহিদা আকাশচুম্বী। তখন পাট নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। গ্রাফটিং মেথড প্রয়োগ করে পাটের হাইড্রোফিলিক ন্যাচার (পানি শুষে নেওয়া) রোধে সফলতা পেলাম। পাটের এই মডিফিকেশন এটাই প্রথম। এর আগে কেউ এভাবে কাজ করেনি। এরপর পাটের সঙ্গে পলিথিন বা পলি প্রপিলিন মিক্স করে কম্পোজিট ম্যাটার তৈরির কাজ চলছিল।

তিনি বলেন, ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আমি বৈঠকে উপস্থিত থেকে বলেছিলাম, পলিথিনের বিকল্প মানুষের হাতে না দিলে এটি বন্ধ হবে না। কিন্তু বৈঠকে বলা হয়েছিল, পাটের বিভিন্ন ব্যাগ, পণ্য বাজারজাত করে পলিথিন বন্ধ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব কিছু করা হয়নি। এখন মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন দোকানে অভিযান চালিয়ে পলিথিন জব্দ করা হয়। কিন্তু এভাবে তো উৎপাদন বন্ধ হবে না। দোকানে অভিযান না চালিয়ে অভিযান চালাতে হবে যেখানে উৎপাদন বা যারা উৎপাদন করে সেখানে গিয়ে। বর্তমানে শপিং ব্যাগেরই সারা বিশ্বে বাজার রয়েছে ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের। খুব সহজেই তারা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বাজারে আসতে দেবে না এটাই স্বাভাবিক। পলিথিন ব্যবহার না করা বা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সভা-সেমিনার করবে। কিন্তু কার্যকর কিছুই তারা করবে না।

মোবারক আহমদ খান বলেন, বাজারে পলিথিন ব্যাগের দাপটের মধ্যেই পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরির চিন্তা করলাম। সেলুলোজ নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। এটি নিয়ে গবেষণার জন্য বেশ কিছু সময় লেগেছে। গবেষণাগারে এর ক্রস লিংকিং সম্পন্ন করে সোনালি ব্যাগের প্রিন্ট তৈরি হলো। সেলুলোজ নিয়ে সফলতা পাওয়ার পর ভাবলাম সেলুলোজের সহজলভ্য উৎস পাট। তারপর পাট নিয়ে কাজ করেও অভাবনীয় সাড়া পেলাম। পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ পলিথিনের ব্যাগের মতোই সহজে বহনযোগ্য, মাটিতে পচে যায়। এটি সম্পূর্ণভাবে ন্যাচারাল পলিমার। এখানে কোনোরকম সিনথেটিক পলিমার ব্যবহার করা হয় না। এতে কোনো প্লাস্টিক উপাদান নেই। এই ব্যাগ পানিতে গেলে পানির কোনো ক্ষতি হয় না। আমরা যা খাই, তেমন উপাদানও এখানে রয়েছে। এই ব্যাগ নদীতে গেলে মাছের খাবার হবে, মাটিতে গেলে সারের উপাদান হিসেবে কাজ করবে। এভাবেই তৈরি করা হয়েছে এই সোনালি ব্যাগ।

তিনি জানান, বর্তমানে সরকারের অর্থায়নে সোনালি ব্যাগের পাইলট স্কেল প্রোডাকশন চলছে। রাজধানীর ডেমরায় লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে এ কাজ চলছে। প্রতিদিন ১ টন সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এর সক্ষমতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করি। আমি চাই কেউ এই ব্যাগ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাক। এই বিজ্ঞানী বলেন, সোনালি ব্যাগ সারা বিশ্বে ব্র্যান্ড হওয়ার মতো প্রোডাক্ট। কিন্তু এর জন্য উদ্যোগ সরকারকেই নিতে নিতে হবে। তাছাড়া এটি ফলপ্রসূ হবে না।

সর্বশেষ খবর