বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের এক অফুরন্ত ভান্ডার। স্বচ্ছ নীল জলরাশি, নয়নাভিরাম নারিকেল গাছের সারি এবং সমৃদ্ধ ও দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের কারণে ভ্রমণপিপাসু ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ। দ্বীপটি শুধু একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রই নয়, বরং অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণের এক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। এখানকার বর্ণিল প্রবাল প্রাচীর এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় লাল অ্যালগি দ্বীপটিকে আন্তর্জাতিকভাবেও পরিচিতি এনে দিয়েছে। পরিবেশ দূষণ ও মানবসৃষ্ট কারণে অমূল্য প্রাকৃতিক ঐতিহ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে শুরু করে সবার সামনেই ধীরে ধীরে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। যা হওয়ার এরই মধ্যে হয়ে গেছে। বাকি যা আছে তা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিবেশ রক্ষায় কঠোর নিয়ম করতে হবে।’ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন তার দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি মনোমুগ্ধকর প্রবাল দ্বীপ। ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির মাছ, ৬৬ প্রজাতির কোরাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং ১২০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। দ্বীপটি প্রবাল প্রাচীরের জন্য বিখ্যাত, যা বিভিন্ন রঙের এবং আকৃতির হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে দূষণ ও অন্যান্য কারণে এই প্রবাল হুমকির মুখে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেন্টমার্টিনের ৪১ শতাংশ প্রবাল ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রবাল ধ্বংসের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪৫ সালের মধ্যে এটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্বীপে অ্যালগি নামে এক ধরনের শৈবাল পাওয়া যায়। যা স্থানীয়ভাবে ‘পেজালা’ নামে পরিচিত।
এখানে পাওয়া লাল অ্যালগি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। অ্যালগি ছাড়াও প্রায় ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল এখানে পাওয়া যায়। দ্বীপের আশপাশে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, ভোল কোরাল, রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ, উড়ুক্কু মাছসহ প্রায় ২৪০ প্রজাতির মাছ দেখা যায়। এখানে ১৫৭ থেকে ১৫৮ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়া এবং লবস্টার পাওয়া যায়। দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়াও প্রাকৃতিক বন তেমন নেই। তবে দক্ষিণ দিকে কিছু কেওড়ার ঝোপঝাড় এবং ম্যানগ্রোভ গাছ দেখা যায়। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেয়া, শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন গাছ এবং প্রচুর নারিকেল গাছ। দ্বীপে প্রায় ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। সবুজ সাগর কাছিম ও জলপাইরঙা সাগর কাছিমের ডিম পাড়ার জন্য দ্বীপটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রায় ১১০ থেকে ১ হাজার ২০০ প্রজাতির পাখির আনাগোনা দেখা যায় এই দ্বীপে। বিশেষজ্ঞদের মত, পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, চায়ের কাপ ইত্যাদি সমুদ্র এবং সৈকতকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। জাহাজের নোঙর, পর্যটকদের অসতর্ক চলাচল এবং দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবাল প্রাচীর। অনেক সামুদ্রিক প্রাণী তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানগুলোও হুমকির মুখে। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের চাহিদা মেটাতে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত হোটেল, রিসোর্ট ও দোকানপাট দ্বীপের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে। পর্যটকদের মিঠা পানির চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানি অধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ফলে দ্বীপে ভারসাম্য হুমকিতে পড়েছে।