প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন। দ্বীপে বসবাস প্রায় ১০ হাজার মানুষের।
এক দশক আগেও দ্বীপের সবারই পেশা ছিল কৃষি ও মাছধরা। জাহাজে করে ব্যাপক হারে পর্যটকের আগমনের কারণে ধীরে ধীরে বদলে যায় তাদের অধিকাংশের পেশাভিত্তিক জীবিকাও। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা তাদের কাছে হয়ে ওঠে মুখ্য। হোটেল, কটেজ তৈরির ফলে কমতে থাকে কৃষি জমিও। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েন। কেউবা লেখাপড়ার তাগিদে পাড়ি জমান মূল ভূখণ্ডে। অনেকের ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার দিকে মনোযোগী হয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রামে চলে যায়। দেখতে থাকে উন্নত জীবনের।
গত মৌসুমে সরকার পর্যটক গমনে বিধিনিষেধ আরোপ করায় দ্বীপবাসীর জীবনে ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করে। পর্যটননির্ভর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে আর্থিক অনটনে পড়ে যান। আর্থিক সমস্যার কারণে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় অনেক পরীক্ষার্থী অংশ নিতে পারেননি। অনেকে আবার সেই পুরোনো পেশায় ফিরে যেতে চান। অনেকে চাইলেও আর পারছেন না। ইতোমধ্যে জমিহারা হয়েছেন অনেক কৃষক। ফলে চারদিকে হতাশা ঘিরে ধরেছে দ্বীপবাসীকে। দ্বীপে অধিকাংশ দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কটেজ, রিসোর্টসহ পর্যটনকেন্দ্রিক সব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ। নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেদের মাছ ধরার নৌকা ঘাটে নোঙর করে পড়ে আছে। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার চরম অভাব-অনটনে দিন পার করছে। স্থানীয়দের চলাচলের ক্ষেত্রেও প্রশাসনের কঠোর নজরদারি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। ৩০ বছর বয়সি রহিম উল্লাহ ছোটবেলা থেকে সমুদ্রে মাছ ধরে সংসারের হাল ধরেন। তিনি বলেন, ‘এখন মাছ ধরা বন্ধ। পর্যটন মৌসুমে ডাব বিক্রি করি। এ বছর পর্যটক কম আসায় আশানুরূপ আয় হয়নি। সামনে বর্ষা মৌসুম। কীভাবে চলব বুঝতেছি না।’ এমন গল্প হাজারো দ্বীপবাসীর। জেলে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হোটেল ও কটেজ শ্রমিক- সবাই কর্মহীন। চলতি বছরের পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং ১৫ এপ্রিল থেকে ১২ জুন পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কার্যকর সহায়তা পাননি জেলেরা। স্থানীয় জেলে মোহাম্মদ করিম বলেন, ‘সাগরে মাছ ধরতে না পারায় বিপাকে পড়েছি। আয় না থাকায় ছেলেদের লেখাপড়ার খরচও দিতে পারছি না। আগে হোটেল বা কটেজে দিনমজুরি করে সংসার চালানো যেত, এখন সে সুযোগও বন্ধ।’ এমন বাস্তবতায় সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর জন্য সম্প্রতি বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে একটি ওয়ার্কিং টিম গঠন করা হয়েছে। যার সদস্য হিসেবে রয়েছে কৃষি, মৎস্য, পর্যটন বোর্ড, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন, ব্র্যাক ও কোস্ট ফাউন্ডেশন। মে মাসের শুরুতে ব্র্যাক ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের দুটি প্রতিনিধিদল দ্বীপ পরিদর্শন করেছে। তারা জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সম্ভাব্যতা যাচাই করে সরেজমিন সেন্টমার্টিন পরিদর্শন করে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের কাছে ২০ মে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন।
প্রস্তাবিত বিকল্প কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে- ‘বিষমুক্ত শুঁটকি মাছের ব্র্যান্ডিং’; ‘পরিবেশবান্ধব জাল ও প্রযুক্তি ব্যবহার’; ‘সবজি ও মাশরুম চাষ’; ‘পোলট্রি ও গবাদিপশু পালন’; ‘নারীদের সেলাই, নকশিকাঁথা, স্মারক তৈরির প্রশিক্ষণ’; ‘নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি তৈরি’; ‘ফটোগ্রাফি ও রেস্টুরেন্ট প্রশিক্ষণ’; ‘স্থানীয় যুবকদের ট্যুর গাইড প্রশিক্ষণ’, সেন্টমার্টিন সংক্রান্ত একটি অ্যাপস তৈরি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এনজিও সহায়তায় পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি তৈরি এবং পর্যটকদের জন্য কম দূরত্বের বিকল্প যাতায়াত রুট। কোস্ট ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দ্বীপের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ পর্যটনের সঙ্গে জড়িত, তারা এখন সবাই বেকার। এ ছাড়া দ্বীপে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে আবার ৭০০-এরও বেশি জেলের নিবন্ধন নেই। ফলে তারা সহায়তাও পান না। এখন চরম আর্থিক কষ্টে আছেন। এ ছাড়া জেলেদের আধুনিক প্রযুক্তিও নেই। তিনি বলেন, দ্বীপের মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান নির্ধারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে একটি ওয়ার্কিং টিম গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে কৃষি, মৎস্য, ট্যুরিজম বোর্ড, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন, ব্র্যাক ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। সেন্টমার্টিন হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি এ রহিম জিহাদি জানান, ‘দ্বীপবাসী আজ অভাব-অনটনে দিন পার করছেন। জীববৈচিত্র্য রক্ষা হোক; কিন্তু মানুষের জীবন চলার পথ বন্ধ করে নয়। ১০ হাজার মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে পর্যটন বন্ধ রাখা যুক্তিসঙ্গত নয়।’ টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘বিকল্প কর্মসংস্থান নির্ধারণে সরকার কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রতিনিধিদল দ্বীপে কাজ করেছে। কোরবানির ঈদের আগে অন্তত ৯০০ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।