বাংলাদেশ কেমন চলছে তা যদি বুঝতে চান তবে সবার আগে কয়েকটি বিষয় আপনাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে। দেশের হালহকিকত কেমন হতে পারে, তা নিয়ে যেমন সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি রয়েছে আবার কোনো একটি রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থা অনুধাবনের জন্য হজরত আলী (রা.)-এর সূত্রটি মহাকালে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। আমি শুধু সক্রেটিস এবং হজরত আলী (রা.)-এর উক্তিগুলো উল্লেখ করব। তারপর চলমান বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আপন মতামত ব্যক্ত করব।
সক্রেটিস বলেন, ‘এমন একটি সময় আসবে যখন মূর্খরা দেশ শাসন করবে এবং দুর্নীতিবাজরা উল্লাসনৃত্য করবে।’ হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘কখন বুঝবে একটি দেশ রসাতলে গিয়েছে যখন সেই দেশের দরিদ্র লোকেরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, ধনীরা কৃপণ হয়ে যায় এবং অযোগ্যরা দেশ শাসন করে।’ আমাদের বাংলাদেশে সক্রেটিস কিংবা হজরত আলী (রা.)-এর বক্তব্য মতে কী কী ঘটছে, তা নিয়ে আপনারা ভাবতে থাকুন আর এ সুযোগে মানুষের মুখের ভাষা, চিন্তা-চেতনা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং যৌনতা কীভাবে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সে বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতে থাকি।
আপনি যদি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখেন তাহলে লক্ষ্য করবেন যারা যত বেশি অশ্লীল এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিতে পারছে লোকজন তাদেরই সর্বজ্ঞানী মনে করছে। অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গীবত, মানি লোকের অমর্যাদা, পরিশ্রমীদের শ্রমকে টিটকারি করা এবং সফলতম মানুষদের নানাভাবে হেয় করে যারা গলাবাজি করছে তারাই এখন সব দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তা। সমাজে যারা আগ বাড়িয়ে নিজেদের নেতা হিসেবে জাহির করছে তাদের ভয়ে মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে নেতার বৈশিষ্ট্য কী? যারা ক্ষমতার দম্ভ করছে তাদের প্রশ্ন করা যাচ্ছে না যে ক্ষমতার উৎস কী। যারা মানুষের ভাগ্যবিধাতা রূপে জীবন-সম্পদ এবং ভূখণ্ডের ওপর কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে তাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করার হিম্মত আমজনতা হারিয়ে ফেলেছে।
বাকরুদ্ধ সমাজ শুধু দেখছে এবং শুনছে। বিকল্প চিন্তা-প্রতিবাদ করা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের রাষ্ট্রচিন্তা এখন মস্তিষ্ক থেকে মুখের মধ্যে চলে এসেছে এবং মুখ-গহ্বরে যাবতীয় ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস একত্র হয়ে মস্তিষ্কের চিন্তাকে রোগাক্রান্ত করে ঠোঁটে নিয়ে আসছে, তারপর প্রকৃতির নিকৃষ্ট প্রাণীদের যাবতীয় ভয়ংকর হুঙ্কারকে ম্লান করে অ্যাটম বোমার শক্তি নিয়ে কিছু মানুষের কণ্ঠস্বর যে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে, তার ফলে রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশের সার্বিক বিষয়াদি টালমাটাল হয়ে পড়েছে।
উল্লেখিত অবস্থায় বাংলার শিল্প-সাহিত্য রসাতলে গেছে। সংস্কৃতি পচে-গলে এমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, যা সামাজিক মাধ্যমে ঢুঁ মারলেই অনুধাবন করা যায়। আমাদের গান, কবিতা, সিনেমা, নাটক থেকে শুরু করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যেসব অশ্লীলতা যুক্ত হয়েছে, তা কোনোকালে বাংলায় ছিল কি না, আমার জানা নেই। আমরা কৈশোরে পড়েছি জীবনই সাহিত্য। অর্থাৎ প্রাত্যহিক জীবনে যা কিছু ঘটে তা গল্প কবিতা উপন্যাসে রূপ নিয়ে কখনো কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় পূর্ণাঙ্গতা পায়। আবার কখনো শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’, ‘অনুরাধা’, ‘মেজদিদি’ কিংবা বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘আনন্দমঠ’-এ আশ্রয় নেয়, রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, সুনীলের ‘সেই সময়’ অথবা সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ মূলত আমাদের জীবনযাত্রার এককালীন প্রতিচ্ছবি।
সাহিত্যের পর সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা পড়েছি তা হলো জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ, যা কিছু উপভোগ্য এবং যা কিছু অনুকরণীয় তা-ই সংস্কৃতি। আমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, নাটক, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদিকে তখনই সংস্কৃতি বলা হয় যখন গ্রামের নৌকাবাইচ, হাডুডু, ষাঁড়ের লড়াই কিংবা জারি সারি ভাটিয়ালির সুর আমাদের একধরনের সুখানুভূতির জগতে নিয়ে যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, অপর বাংলার ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পথের পাঁচালী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র যখন জীবন সম্পর্কে মানুষকে নতুন চিন্তার প্রেরণা দেয় ঠিক তখনই তা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠে।
গানের রাজ্যে আমরা গীতিকার-সুরকার, কবিয়াল হিসেবে এ বাংলায় যাঁদের পেয়েছি, তাঁদের কথা ও সুর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করে আছে তা হয়তো ওমন করে ভাবা হয়নি; কিন্তু যখন আবদুল আলীমের কণ্ঠে ‘হলুদিয়া পাখি’, নীনা হামিদের ‘আমার সোনার ময়না পাখি’, শাহ আবদুল করিমের ‘বন্দে মায়া লাগায়ছে, পিরিতি শিখায়ছে’ অথবা শচীন দেব বর্মণের ‘কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া, আমার ভাইধন রে কইয়ো নাইওর নিতো আইয়া’- গানের সুর শুনলে মনের মধ্যে যে তোলপাড় শুরু হতো তাতে করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের মানবিক সম্পর্ক, জীবনবোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ধর্মকর্ম আধ্যাত্মিকতার চিন্তা চলে আসে এবং আমরা আবেগ-অনুভূতি আচরণে যে পশু নই তা নতুন করে ভাবতে অনুপ্রাণিত হই। ফলে জীবনের সঙ্গে সাহিত্য এবং সাহিত্যের সঙ্গে সংস্কৃতি সংযোগ ঘটিয়ে আমরা মানুষরূপে বেড়ে উঠি এবং মানুষের মতো করে মরার স্বপ্ন দেখি।
কিন্তু হাল আমলে আমাদের জীবনে মানবিকতার পরিবর্তে এমন অদ্ভুত পাশবিকতা চলে এসেছে যা কি না, প্রকৃতিতে নেই। আমাদের ফোঁসফাঁসের সঙ্গে সাপের ফোঁসফাঁসের পার্থক্য হলো, সাপ ভয় দেখিয়ে বা ভয় পেয়ে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ফোঁসফাঁস করে আর আমরা অন্যের জীবন- যৌবন, সহায়সম্পদ হরণের জন্য ফোঁসফাঁস করি। শিয়াল পেটের দায়ে মুরগি চুরি করে এবং মনের আনন্দে হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া করে। আর আমরা বাড়ি-গাড়ি-ক্ষমতালাভের জন্য চুরি করি এবং অন্যের মনে মৃত্যুর আতঙ্ক তৈরির জন্য হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া শব্দ করে দুনিয়াকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলি।
উল্লেখিত কারণে হাল আমলে কোনো সাহিত্য তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি তা অপসংস্কৃতির চরম পরাকাষ্ঠায় কীভাবে পরিণত হয়েছে তার কিছু নমুনা প্রকাশ করার জন্য আজকের শিরোনামের শব্দমালা ব্যবহার করেছি। আপনি যদি দুই সপ্তাহ ধরে সামাজিকমাধ্যমে ট্রেন্ডিং হওয়া ভাইরাল বাংলা গানগুলোর দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন জনৈক অদ্ভুত যুবক ও যুবতী অদ্ভুত পোশাক-আশাকে সজ্জিত হয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে কয়েকটি গান করছে, যেগুলোর মধ্যে ‘বিষম পিরিতি’, ‘তালা তালা, কালা কালা’ ইত্যাদি শব্দসংবলিত গানগুলো বাজছে। আমি কোনো ভিডিওর দিকে পাঁচ সেকেন্ডও তাকাই না, কিন্তু তারপরও ফেসবুকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বারবার ওই সব অশ্লীল ‘কালা কালা, তালা তালা’র যন্ত্রণা আমার সামনে চলে আসে।
স্বল্পতম সময়ে যতটুকু শুনেছি তাতে মনে হয়েছে পশ্চিমা অপসংস্কৃতির আদলে বাংলা শব্দমালার বলাৎকার করে গানের কথামালা রচনা করা হয়েছে এবং দেশি-বিদেশি দশ-বারোটি গানের সুর নকল করে একটি রিমিক্স সুর তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি এবং বিশেষ ডিজাইনে তৈরি পোশাক, যা কি না মানব শরীরের লজ্জাস্থানগুলোকে লজ্জার গোপন কুঠুরি থেকে আপনার চোখের ওপর প্রতিস্থাপনের জন্যই করা হয়েছে। গানের সঙ্গে বিদেশি বাদ্যযন্ত্র, গায়ক-গায়িকার অদ্ভুত নৃত্য এবং নৃত্যের মাধ্যমে শরীরে ত্রিভুজকে জনসমক্ষে প্রদর্শনের নানান কসরত দেখে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে আপনি গান শুনছেন নাকি ময়লাযুক্ত গোপন অঙ্গের আঁকাবাঁকা দৃশ্য দেখছেন।
আপনি যদি উল্লেখিত অপসংস্কৃতির তাণ্ডবের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সুপার-ডুপারহিট হওয়া সিনেমাগুলোর গান-কাহিনি শোনেন এবং হালফ্যাশনের চলচ্চিত্রের সংলাপ ‘জিল্লু মাল দে’ ভাব সম্প্রসারণ করেন তবে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন দেশ কীভাবে চলছে, কারা চালাচ্ছে এবং আপনি আপনার দেশে কেমন আছেন এবং সর্বোপরি আপনি এ-ও বুঝতে পারবেন যে ‘কালা কালা তালা তালা’র সমাজের চাবি কার হাতে এবং আপনার দৈনন্দিন জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণার গন্তব্য কত দূর!
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক