শ্রীনগরের শান্ত, সরু গলিপথে একটি ছোট, স্বল্প-আলোকিত ঘর দাঁড়িয়ে আছে। যা এক বিলুপ্তপ্রায় শিল্পের শেষ আশ্রয়স্থল। এই ঘরের ভেতরে বসে আছেন গুলাম মোহাম্মদ জাজ। তাকে কাশ্মীর অঞ্চলের শেষ হস্তনির্মিত সন্তুর শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়।
সন্তুর হলো একটি ট্র্যাপিজয়েড-আকৃতির তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র। যা দেখতে অনেকটা ডালসিমারের মতো এবং এটি হাতুড়ি দিয়ে বাজানো হয়। এর স্ফটিকের মতো ঘণ্টা বাজানোর শব্দের জন্য এটি পরিচিত এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি কাশ্মীরের বাদ্যযন্ত্রের প্রতীক হয়ে আছে।
গুলাম মোহাম্মদ জাজ এমন এক কারিগর বংশের সদস্য, যারা সাত শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীরে তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে আসছেন। জাজ পরিবারের নাম দীর্ঘকাল ধরে সন্তুর, রবাব, সারেঙ্গি এবং সেতারের নির্মাতাদের সমার্থক হিসেবে পরিচিত।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, হাতে তৈরি বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা কমে গেছে। এর স্থান দখল করে নিয়েছে যন্ত্রে তৈরি সস্তা ও দ্রুত উৎপাদনযোগ্য সংস্করণ। একই সাথে সঙ্গীতের রুচিও পরিবর্তিত হয়েছে, যা এই শিল্পের পতনে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে।
সঙ্গীত শিক্ষক শাবির আহমদ মির বলেন, হিপ হপ, র্যাপ এবং ইলেকট্রনিক সঙ্গীত এখন কাশ্মীরের সাউন্ডস্কেপে আধিপত্য বিস্তার করায়, তরুণ প্রজন্ম ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের গভীরতা বা শৃঙ্খলার সাথে আর সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। তিনি আরও যোগ করেন, এর ফলে সন্তুরের চাহিদা কমে গেছে, যার কারণে কারিগররা কোনো শিক্ষানবিশ বা টেকসই বাজার পাচ্ছে না।
গুলাম মোহাম্মদের দোকানে একটি ছবিতে পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা এবং ভজন সোপোরিকে তার তৈরি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে পরিবেশন করতে দেখা যায়। ২০২২ সালে তিনি ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'পদ্মশ্রী' লাভ করেন, যা তার কারুশিল্পের স্বীকৃতি।
১৯৪০-এর দশকে জাইনা কাদালে গুলাম মোহাম্মদ জাজের জন্ম। এটি এমন একটি এলাকা যা একসময় কাশ্মীরের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি তার পরিবারের বাদ্যযন্ত্র তৈরির শব্দ এবং সরঞ্জামের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন।
স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে অল্প বয়সেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়তে হয়। তখনই তিনি তার বাবা ও দাদার কাছ থেকে সন্তুর তৈরির শিল্প শিখতে শুরু করেন, যারা উভয়েই ছিলেন এই শিল্পের ওস্তাদ কারিগর।
তিনি বলেন, তারা আমাকে শুধু বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে শেখাননি, বরং শুনতে শিখিয়েছেন – কাঠকে, বাতাসকে এবং যে হাতগুলো এটি বাজাবে, তাদের কথা শুনতে। আমার পূর্বপুরুষদের স্থানীয় রাজাদের দরবারে ডাকা হতো এবং প্রায়শই তাদের এমন বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে বলা হতো যা হৃদয়কে শান্ত করতে পারে।
তার ঘরে ছেনি ও তার দিয়ে ভরা একটি কাঠের বেঞ্চ একটি অসম্পূর্ণ সন্তুরের কঙ্কালসার কাঠামোর পাশে পড়ে আছে। বাতাসে পুরোনো আখরোট কাঠের হালকা গন্ধ কিন্তু কোনো যন্ত্রপাতির চিহ্ন নেই।
গুলাম মোহাম্মদ বিশ্বাস করেন, যন্ত্রে তৈরি বাদ্যযন্ত্রে হাতে তৈরি বাদ্যযন্ত্রের উষ্ণতা ও গভীরতা থাকে না এবং এদের অডিও গুণমানও তার ধারেকাছে আসে না।
এই কারিগর বলেন, সন্তুর তৈরি করা একটি ধীর প্রক্রিয়া। এটি সঠিক কাঠ নির্বাচন দিয়ে শুরু হয়, যা কমপক্ষে পাঁচ বছরের পুরোনো এবং শুষ্ক। তারপর খোদাই করা হয় এবং সর্বোত্তম অনুরণনের জন্য ফাঁপা করা হয়। ২৫টি সেতুর প্রতিটি নির্ভুলভাবে আকার দেওয়া ও স্থাপন করা হয়। ১০০টিরও বেশি তার যোগ করা হয়। এরপর সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা এমনকি মাসখানেক ধরে কষ্টকর সুর বাঁধার প্রক্রিয়া চলে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রভাবশালীদের অনেকে গুলাম মোহাম্মদের কর্মশালা পরিদর্শন করেছেন এবং তার গল্প অনলাইনে শেয়ার করেছেন। তিনি এই মনোযোগের প্রশংসা করেন কিন্তু বলেন, এটি শিল্প বা তার ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য বাস্তব কোনো প্রচেষ্টা নিয়ে আসেনি। তারমতে, ‘এরা ভালো মানুষ কিন্তু আমি চলে গেলে এই জায়গাটার কী হবে?’
তার তিন মেয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকায় পরিবারে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই। বছরের পর বছর ধরে, তিনি সরকারি অনুদান, শিক্ষানবিশদের প্রতিশ্রুতি, এমনকি রাজ্য হস্তশিল্প বিভাগ থেকেও প্রস্তাব পেয়েছেন।
তবে গুলাম মোহাম্মদ বলেন যে তিনি খ্যাতি বা দাতব্য খুঁজছেন না। তিনি যা চান তা হলো, কেউ এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাক। তার মতে, এটি শুধু কাঠের কাজ নয় এটি কবিতা। একটি ভাষা। একটি জিহ্বা যা আমি বাদ্যযন্ত্রকে দিই।
আমি বাজানোর আগেই সন্তুরের সুর শুনতে পাই। এটাই রহস্য। এটাই সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তার ভাষায়, কাঠ এবং সঙ্গীত; সময় না দিলে উভয়ই মরে যায়। আমি এমন কাউকে চাই যে সত্যিই এই শিল্পকে ভালোবাসে, যে এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অর্থের জন্য নয়, ক্যামেরার জন্য নয়, সঙ্গীতের জন্য।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল