টেকসই কৃষি গড়ে তোলা ও কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষিসেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে গাইবান্ধায় যাত্রা শুরু করেছে কৃষি হাসপাতাল। ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নিয়েছেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মহিদুল ইসলাম। কৃষি হাসপাতালের পাশাপাশি তিনি গড়ে তুলেছেন একটি কৃষি পাঠাগারও। যা কৃষকদের জ্ঞান এবং তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গার মহিদুল ইসলামের এ উদ্যোগ সবার নজর কেড়েছে। জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের রামধন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মহিদুল
বসতবাড়ির ৫২ শতক জায়গায় গড়ে তুলেছেন পারিবারিক পুষ্টি বাগান। তার বাগানে রয়েছে- স্কোয়াশ, ক্যাপসিকাম, বেগুন, টম্যাটো, শিম, লাউ, গাজরসহ ২৮ প্রকারের সবজি। রয়েছে পিঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, তেজপাতা, আলুবোখারা, চুই ঝালসহ ১০ থেকে ১২ প্রকারের মসলা জাতীয় গাছ। ১২ প্রকারের ক্যাকটাস ও ৩ শতাধিক শোভাবর্ধনকারী গাছ। আরও আছে- স্ট্রবেরি, থাই আমড়া, মিষ্টি তেঁতুল, কতবেল, নারিকেল, ১০ প্রকারের আমসহ অর্ধ শতাধিক ফলদ এবং গর্জন, মেহগনি, গামারি, লম্বুসহ ১৫ থেকে ১৬ প্রকারের বনজ গাছ। এ ছাড়াও আখ এবং বেশ কয়েক প্রকারের ঔষধি ও বনসাঁই রয়েছে তার বাগানে। রয়েছে জৈব সার উৎপাদনের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট প্রকল্প। বাড়ির পাশের পুকুরে চাষ করছেন টেংরা, পুঁটি, মোয়া, শিং, কইসহ নানা রকম দেশীয় মাছ। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে বড় ভাই পরে বাবার মৃত্যুর পর মহিদুল ভীষণ একা হয়ে যান। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে তিনি বাগান তৈরি ও পরিচর্যায় মনোযোগী হন। ২০১৭ সালে দেড় শতক জমি বিক্রির ৭০ হাজার টাকা দিয়ে নিজ বাড়িতে এ কৃষি প্রকল্পটি গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এ প্রকল্প থেকে বর্তমানে তার মাসিক আয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এ কাজে তার সহযোগী হিসেবে আছেন স্ত্রী ও পুত্র সন্তান। বাগানের এক পাশে বসতবাড়ির আঙিনায় রয়েছে নারিকেল পাতা আর ছনের ছাউনি দেওয়া বাঁশের তৈরি একচালা ঘর। এ ঘরেই চলে মহিদুলের কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগারের কার্যক্রম। বিনামূল্যে কৃষি প্রযুক্তি ও চাষবিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য এবং জ্ঞান সহজে পেতে কৃষকরা এখানকার কৃষি পাঠাগার
থেকে চাইলেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিতে পারেন বই, আবার নির্দিষ্ট সময়ের পর ফেরত দিয়ে নিতে পারেন অন্য বই। কৃষি সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পেতে এখানে ভিড় জমান নানান বয়সি কৃষক, অনেকে এখানে বসেই বই পড়েন আবার অনেকে বই নিয়ে যান নিজের বাড়িতে। এ ছাড়া কৃষি হাসপাতাল থেকে কৃষকরা তাদের ফসলের যে কোনো সমস্যায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। এখানকার পরামর্শ কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উন্নত চাষ পদ্ধতি ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করছে। এতে কৃষকদের সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। মহিদুলের কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিভিন্ন ফসলের রোগ শনাক্ত এবং রোগের কারণ নির্ণয় করতে স্থানীয় চাষিরা কৃষি হাসপাতালে আসছেন। মহিদুলের এমন উদ্যোগ নজর কেড়েছে কৃষি বিভাগের কর্তাদেরও। সম্প্রতি কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার কার্যক্রম পরিদর্শনে এসেছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম। তিনি গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার কার্যক্রমের একটি ডকুমেন্টারি তৈরির নির্দেশ দেন। মহিদুল জানান, কৃষি হাসপাতাল একটি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, যা উদ্ভিদ ও কৃষি ফসলের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে নিবেদিত। এটি মানুষের হাসপাতালের মতো, তবে এখানে রোগী হলো ফসল, গাছপালা এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য। আর কৃষি পাঠাগার হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে কৃষিকাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, জ্ঞান ও উপকরণ সংগ্রহ করে রাখা হয় এবং কৃষকদের জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। এটি কৃষকদের কৃষিকাজ সম্পর্কে জ্ঞান বাড়াতে, নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ পর্যন্ত কৃষি হাসপাতালের সেবা নিয়েছেন শতাধিক কৃষক। এ ছাড়া কৃষি পাঠাগারে প্রতিদিন পাঠক উপস্থিতি ২০ থেকে ২৫ জন। তিনি বলেন, বাবা আবদুল ওয়াহেদ বন বিভাগে চাকরি করতেন। বাবার কারণেই ছেলেবেলা থেকেই গাছ-গাছালির প্রতি তার আকর্ষণ তৈরি হয়। ভালো জাতের ফলের চারা সংগ্রহ ও কলম করে রাখতেন বাড়িতে। সেগুলো যদি ভালো ফলন দিত; তবে তিনি সেই জাতের বীজ বাড়িয়ে আশপাশের কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতেন। সুযোগ পেলেই তিনি কৃষিবিষয়ক বই জোগাড় করে মন দিয়ে পড়তেন। যতটুকু সম্ভব কৃষকদের কৃষিবিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন। ক্রমে ক্রমে তার কৃষি ও মৎস্য এবং পশুসম্পদসহ বিভিন্ন বিষয়ে বইয়ের একটা মজুত তৈরি হয়। তথ্যনির্ভর এসব বই একসঙ্গে কোথাও পাওয়া যায় না। এ জন্য পাঠাগার করার কথা ভাবেন। গত তিন বছর ধরে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে সম্প্রতি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেছেন। কৃষিবিদরা বলছেন, কৃষি হাসপাতাল ও কৃষি পাঠাগার কৃষকদের আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক এবং কৃষি যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে, কৃষি কাজে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করবে। গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মহিদুলের ‘কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার’ উদ্ভাবনী ধারণাটি কৃষি বিভাগের নজরে এসেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায় থেকে এ উদ্ভাবনী উদ্যোগকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।’